বাংলাদেশের খ্যাতনামা বামপন্থী চিন্তাবিদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর আজ শনিবার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন একজন অগ্রণী বামপন্থী রাজনীতিক, প্রগতিশীল চিন্তার ধারক এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ও গবেষণার লেখক। তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন বদরুদ্দীন উমর। তাঁর পিতা ছিলেন বরিশালের জেলা জজ এবং মা শিক্ষিত গৃহিণী। ছাত্রজীবনেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম তাত্ত্বিক ও সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
শিক্ষাজীবনে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন করেন এবং পরে দেশে ফিরে এসে সমাজ ও রাজনীতির নানা স্তরে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
বদরুদ্দীন উমরের লেখনী ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজবিজ্ঞান ও বাম রাজনীতির নানা বিষয়ের উপর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০-এরও বেশি।
১৯৭০-এর দশকে তিনি সাপ্তাহিক গণশক্তি ও মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি চালু করেন তাত্ত্বিক পত্রিকা নয়া পদধ্বনি, যা বামপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়।
২০২৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, বদরুদ্দীন উমর তা গ্রহণে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, “আমার রাজনৈতিক আদর্শ এবং রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান পরস্পরবিরোধী। এই পুরস্কার গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, বিভিন্ন বামপন্থী দল, লেখক-সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক অনমনীয় আদর্শের প্রতীক। তিনি আপসহীন ছিলেন, যুক্তিনিষ্ঠ ছিলেন, ছিলেন এক সাহসী মেধার বাতিঘর।” বদরুদ্দীন উমর শুধু রাজনীতিক ছিলেন না—তিনি ছিলেন গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ, সংগঠক ও শিক্ষক।
তাঁর জীবন ছিল সমাজ পরিবর্তনের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, “শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হলে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের বিকল্প নেই।”
তাঁর মরদেহ আজ সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হবে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু বাংলাদেশের চিন্তাশীল সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন এক নির্ভীক কণ্ঠ, যিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। বাম রাজনীতি ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তাঁর অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশ হয়ে থাকবে।