যুক্তরাজ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক ঘৃণা-অপরাধের শিকারদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি— এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে নতুন এক সমীক্ষায়। ইসলামোফোবিয়া এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি ব্রিটিশ সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত কাঠামোগত বৈষম্যের প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘বেটার কমিউনিটিজ ব্রাডফোর্ড (বিসিবি)’ নামের একটি সংস্থা ২০২৫ সালের জুন মাসে এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করে। এতে অংশ নেওয়া ২২ শতাংশ উত্তরদাতা সরাসরি জানান, মুসলিমরাই ধর্মীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও অপমানের শিকার হন।
পরিসংখ্যান যা উদ্বেগ বাড়ায়
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.৫ শতাংশ হলেও, ধর্মভিত্তিক সব ঘৃণা-অপরাধের মধ্যে ৪২ শতাংশ ঘটনাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটে।
অন্যদিকে, ঘৃণা-অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন ‘টেল মামা ইউকে’ জানায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে রেকর্ডকৃত মুসলিম-বিরোধী ঘটনার সংখ্যা ৪,৯৭১— যা গত ১৪ বছরে সর্বোচ্চ।
কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাঙ্গনেও বৈষম্য
সমীক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো— অংশগ্রহণকারীদের এক-তৃতীয়াংশ বলেছেন, তাঁরা কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলাম-বিরোধী মন্তব্য বা আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতি ১০ জনে ১ জন জানিয়েছেন, তাঁরা নিয়মিত এ ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ঘৃণার বিস্তার প্রবল। প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ইসলামোফোবিক কনটেন্ট দেখেছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতেই।
ইসলামোফোবিয়া: পরিকল্পিত প্রচারণার ফল?
বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী আব্বাস নজিব বলেন,
“ইসলামোফোবিয়া এখন কেবল জনসাধারণের মনোভাব নয়, এটি গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলের কিছু অংশের সুপরিকল্পিত প্রচারণার ফল। এটি কাঠামোগত বৈষম্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রতিফলন।”
তিনি আরও জানান, এই ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়তে বিসিবি ‘Unity’ নামে একটি জাতীয় উদ্যোগ চালু করেছে, যার লক্ষ্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো এবং বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশি মুসলিমদের ওপর প্রভাব
এই প্রবণতা ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। হিজাব পরা নারীরা প্রকাশ্য স্থানে নিজেদের অনিরাপদ মনে করছেন, এবং মুসলিম পরিচয়ধারী চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও তুলনামূলকভাবে কম— এমন তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়।
এই পদ্ধতিগত বৈষম্য মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবন, মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাবোধ এবং সমাজে অন্তর্ভুক্তির অনুভূতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ইসলামোফোবিয়া টিকিয়ে রাখার দায় কার?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু গণমাধ্যম ও রাজনীতিক মুসলিমদের ‘ব্রিটিশ মূল্যবোধের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ’, ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত’ বলে উপস্থাপন করে, যার ফলে নেতিবাচক স্টেরিওটাইপ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
এছাড়া, ইহুদিবিদ্বেষের মতো ইসলামোফোবিয়ার কোনো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক সংজ্ঞা না থাকায়, এটি মোকাবিলাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও অনলাইন ঘৃণা
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভূরাজনৈতিক সংঘাত যেমন— ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু, মুসলিমদের বিরুদ্ধেই প্রতিক্রিয়ায় ঘৃণার বিস্তার ঘটায়। একে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি অতিরিক্ত ‘চাপ’ হিসেবেই দেখা হয়।
সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং মিথ্যা দাবির কারণে মুসলিম ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণার পরিবেশ আরও উসকে উঠছে।
প্রতিরোধে দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ
ইসলামোফোবিয়া রোধে শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নয়, অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী ও অমুসলিমদের সঙ্গেও ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘মসজিদ খোলা দিবস’, কমিউনিটি ইভেন্ট, এবং ইন্টারফেইথ সংলাপ এই ঘৃণার দেয়াল ভাঙতে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
‘বেটার কমিউনিটিজ ব্রাডফোর্ড’ ও ‘টেল মামা ইউকে’-র মতো সংস্থাগুলোর মতে, ঘৃণা-অপরাধের রিপোর্টিং, জনসচেতনতা এবং নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।