যখন লাখো মুসল্লি আকাশপথে কিংবা বাসে করে মক্কায় হজ পালন করতে পৌঁছান, তখন তিন স্প্যানিশ মুসলমান বেছে নিয়েছেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক পথ—৬,৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন ঘোড়ায় চড়ে। সাত মাসের এই দীর্ঘ ও কঠিন যাত্রা শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যেই নয়, বরং অতীতের এক প্রাচীন ইসলামিক রুটকে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টাও।
আবদেলকাদির হারকাসি আইদি, তারেক রদ্রিগেজ, ও আবদাল্লাহ রাফায়েল হেরনান্দেজ মানচা—এই তিন যাত্রী ২০২৪ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করেন দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়ার আলমোনাস্তার লা রিয়ালের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ থেকে। যাত্রার শুরুতে তাদের সঙ্গে ছিলেন মোহাম্মদ মেসবাহি, তবে ঘোড়ার অসুস্থতার কারণে তাকে ফিরে যেতে হয়।
এই রুটটি আন্দালুসীয় মুসলমানদের ঐতিহ্যের অংশ, যা প্রায় ৫০০ বছর ধরে বিলুপ্ত। ইতিহাস শিক্ষক হেরনান্দেজ মানচা, যিনি ৩৬ বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেন, এই যাত্রাকে দেখেন তার সেই প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন হিসেবে।
চার বছরের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, এবং অর্থ জোগাড়ের পর তারা রওনা দেন খুজেস্তানি জাতের ঘোড়া নিয়ে। দিনে গড়ে ৪০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তারা নিজেরা রান্না করতেন, রাতে ঘুমাতেন তাবুতে। আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করেছেন।
ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি থেকে শুরু করে বসনিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক—প্রতিটি দেশে পেয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্তরিক সাড়া। তুরস্কে পবিত্র রমজান মাসে তারা রোজা রেখেই যাত্রা চালিয়ে যান এবং ইফতার ভাগাভাগি করেন স্থানীয়দের সঙ্গে।
পরবর্তীতে সিরিয়া, জেরুজালেম ও জর্ডান হয়ে তারা সৌদি আরবে প্রবেশ করেন। কিছু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তাদের ঘোড়াগুলো রিয়াদে রেখে মদিনায় পাঠানো হয় ফ্লাইটে। সৌদি সরকার তাদের থাকা ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করে। মদিনা থেকে শেষ গন্তব্য, মক্কা—সেখানে তারা পৌঁছান হজ পালনের প্রস্তুতি নিয়ে।
আবদেলকাদির হারকাসি আইদি বলেন, “এটি ছিল অসম্ভব এক যাত্রা, যা সম্ভব হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছায়। আমরা শুধু হজ করতেই আসিনি, বরং স্প্যানিশ মুসলমানদের ইতিহাস ও পরিচয়ও তুলে ধরতে চেয়েছি।”
তবে যাত্রার শেষে রয়ে গেছে কিছুটা বিষণ্নতা। ঘোড়াগুলো আর ফিরে যাবে না নিজ দেশে। প্রশাসনিক বিধি এবং তাদের ক্লান্তি বিবেচনায় সৌদি আরবেই তাদের জন্য উন্নত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এই যাত্রা শুধু হজের গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, বরং ইতিহাস, বিশ্বাস, ত্যাগ ও মানবিক সংহতির এক জীবন্ত দলিল।