যুক্তরাজ্যে এক মাসের ব্যবধানে দুইটি পৃথক ঘটনায় মা ও বাবাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দুই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি যুবকের বিরুদ্ধে। এই মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটিতে গভীর শোক ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। একইসঙ্গে, মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক কলহ এবং মাদকাসক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রথম ঘটনা ঘটে ২৬ জুন, পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের বো এলাকায়। পারিবারিক কলহের জেরে ২৭ বছর বয়সী লায়েক মিয়া তার মাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা নিহত নারীকে একজন সহানুভূতিশীল ও পারিবারিক মানসিকতার মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঘটনার সময় তার স্বামী স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন।
হত্যার কারণ এখনও নিশ্চিত নয়, তবে পারিবারিক উত্তেজনা ও মাদকাসক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চলছে।
এর কিছুদিন পর, দক্ষিণ ওয়েলসের কার্ডিফে ঘটেছে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। ৩৮ বছর বয়সী সাইফুর রহমান ঘুমন্ত অবস্থায় তার পিতা, ব্যবসায়ী আতাউর রহমানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহতের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, সাইফুর দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। কয়েক দিন আগে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে আনা হয়। এক বছর আগে তার মায়ের মৃত্যুতে পরিবারটি ছিল চরম মানসিক চাপের মধ্যে।
দুইটি ঘটনাই পরিবারভিত্তিক সহিংসতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটি নয়, পুরো যুক্তরাজ্যজুড়েই মানসিক অসুস্থতা এবং মাদকসেবন সম্পর্কিত পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারের ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, পিতামাতাকে হত্যার বেশিরভাগ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির মানসিক সমস্যা থাকে, বিশেষ করে সিজোফ্রেনিয়া কিংবা মাদকাসক্তির ইতিহাস। এসব সমস্যা কোনও নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে এক শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ যুবক এবং ২০২২ সালে এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভূত যুবক তাদের মা’কে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়, যাদের উভয়েরই মানসিক রোগ ছিল।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের ট্রেজারার, সাংবাদিক মাহবুবুল করিম সুয়েদ। তিনি বলেন, “কয়েক মাসের ব্যবধানে একই কমিউনিটিতে বাবা ও মা খুনের ঘটনা আমাদের বড় ধরনের আত্মসমালোচনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উন্নত জীবনের আশায় আসা অভিবাসীদের মধ্যে এমন বর্বরতা অত্যন্ত হতাশাজনক।”
লন্ডনের ল ম্যাট্রিক সলিসিটরসের পার্টনার ব্যারিস্টার লাহ উদ্দিন সুমন বলেন, “এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও এর পেছনে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। মানসিক অসুস্থতা থাকলে সেটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। সুস্থ মানসিক অবস্থায় কেউ নিজের মা-বাবাকে হত্যা করতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এই ধরনের ঘটনা শুধু শোকের নয়, সতর্ক হওয়ারও উপলক্ষ। এখনই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সচেতনতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।”