বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন গড়ে ১,৪০০টিরও বেশি ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে অনেকগুলো ছোট মাত্রার হওয়ায় গুরুত্ব পায় না। তবে ঢাকাসহ আশপাশের ৩০০ কিলোমিটার এলাকায় গত এক দশকে রিখটার স্কেলে ৪ বা তদূর্ধ্ব মাত্রার প্রায় ৯৭টি ভূমিকম্প হয়েছে — অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ১০টি।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিহাস বলছে, ১৮৯৭ সালের ‘গ্রেট আসাম ভূমিকম্পে’ (মাত্রা ৮.১) ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল। এমনকি নদীর গতিপথ পর্যন্ত বদলে যায়।
আজকের গবেষণা বলছে, ঢাকার নিচে এখনো জমে আছে বিশাল টেকটোনিক চাপ, যা ৮ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। মধুপুর ও ডাউকি ফল্ট অঞ্চলগুলো থেকে এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। যদি এমন ভূমিকম্প হয়, ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ ভবন ধসে পড়তে পারে এবং প্রাণহানির সংখ্যা হতে পারে লক্ষাধিক।
ঢাকার অবকাঠামো যে ভয়াবহভাবে দুর্বল, তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। রাজউকের জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক ভবনই বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুসরণ না করেই নির্মিত হয়েছে। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, খিলগাঁও ও ধানমন্ডির অধিকাংশ ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ঢাকার মাটির গঠন এমন যে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ এই ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ঢাকার নরম মাটিতে ভূমিকম্প হলে লিকুইফ্যাকশন নামে এক প্রক্রিয়ায় মাটি তরলের মতো আচরণ করতে পারে, যা ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা অনেক বাড়ায়। সেই সঙ্গে, রাজধানীর বহু এলাকায় রাস্তাঘাট এতটাই সংকীর্ণ যে দুর্যোগে উদ্ধারকাজ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষ করে পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, শাজাহানপুর ও উত্তর/দক্ষিণখানের মতো এলাকাগুলো উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কি করা উচিত?
পুরো শহর একদিনে বদলে ফেলা সম্ভব নয়, তবে ভূমিকম্প মোকাবিলায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনই নেওয়া দরকার:
-
BNBC অনুসারে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা
-
পুরনো ভবনে রেট্রোফিটিং প্রযুক্তি প্রয়োগ
-
জলাভূমি ভরাট বন্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
-
সড়ক প্রশস্ত করা ও উদ্ধারপথ নির্ধারণ
-
নগর পরিকল্পনায় ভূমিকম্প সহনশীলতা বিবেচনা
ঢাকার বাইরেও ঝুঁকি
শুধু ঢাকা নয়, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ অনেক এলাকাও বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনায় রয়েছে। ইউএনডিআরআর-এর মতে, দেশের ৭০% উপজেলার ভবন সিসমিক স্ট্যান্ডার্ড না মেনেই নির্মিত হয়েছে।
এ সংকটের দায় শুধু কর্তৃপক্ষের নয়, নাগরিকদেরও। অর্থ আর সুবিধা দেখে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা বিসর্জন দেওয়ার ফল পুরো সমাজকে ভোগ করতে হতে পারে।
লেখক:
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)