
‘দেনাদারেরাই উল্টা মহসিন খানের নামে মামলা করেছিলেন’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে নিজের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে পুলিশ। এছাড়াও লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার রাত ৯টার দিকে আত্মহত্যার এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার ৭ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাড়ির মহসিন খানের নিজ বাসায়। ঘটনাস্থলে পিস্তলের লাইসেন্স এবং কাফনের কাপড়ও পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে খুবই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন আবু মহসিন খান। যাঁদের কাছ থেকে টাকা পেতেন, তারাই উলটা তাঁর নামে মামলা করেছে।
আবু মহসিন খানের বড় মেয়ে তিনা চলচ্চিত্র অভিনেতা রিয়াজের স্ত্রী; তাঁরা রাজধানীর বনানীতে থাকেন। নিহত ব্যবসায়ীর স্ত্রী ছোট ছেলে নিশানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। নিজ সন্তানদের প্রতি ফেসবুক লাইভে ক্ষোভের কথা জানালেও আত্মহত্যার ঠিক আগে তাদের প্রতি দিয়েছেন বাবা হিসেবে শেষ উপদেশ।
এরই মধ্যে ঘটনাস্থলের বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি জোনের এসি আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, ‘আমরা যে আলামত পেয়েছি, তাতে ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। ব্যবসায়িক কিছু লেনদেনে উনি খুব হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। যাঁদের কাছ থেকে টাকা পেতেন, উনারা উলটা তাঁর নামে মামলা করেছেন বলে আমরা দেখেছি। এগুলো নিয়ে উনি আসলে ব্যক্তিগতভাবে খুব হতাশাগ্রস্ত ছিলেন।’
আত্মহত্যার আগে যা বলে গেলেন মহসিন খান
‘আমি মহসিন। ঢাকায় থাকি। আমার বয়স ৫৮ বছর। কোনো এক সময়ে আমি ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাই, আমার ব্যবসা কিংবা কোনো কিছুই নেই। ভিডিও লাইভে আসার উদ্দেশ্য হলো—মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আমার যে এক্সপেরিয়েন্স, সেটা শেয়ার করলে হয়তো সবাই জানতে পারবে, সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবে।’
‘গত ৩০ তারিখ আমার খালা মারা যান। তাঁর একটি ছেলে আমেরিকায় থাকে। মা মারা গেল অথচ ছেলেটি আসল (এলো) না। এটা আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে। কষ্ট লেগেছে।
‘আজকে আমার আরেকজন খালা মারা গিয়েছেন। তাঁরও একটি ছেলে আমেরিকায় ছিল। অবশ্য তাঁর তিনটা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তিনজনই বর্তমানে বাংলাদেশে আছেন। তারা হয়তো দাফন–কাফনের কাজ সম্পন্ন করছে। সেদিক দিয়ে বলব, এ খালা অনেকটা লাকি।
‘আমার একটামাত্র ছেলে। সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। আমার বাসায় আমি সম্পূর্ণ একা থাকি। আমার খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে খুব ভয় করছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি।
‘ছেলে–মেয়ে, স্ত্রী—যাদের জন্য যা–ই কিছু আমরা করি। আমরা সব কিছু করি সন্তান ও ফ্যামিলির জন্য। আপনি যদি একশ টাকা ইনকাম করেন, আয় করেন; তার টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকাও আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন না। যদি টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকা আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন, তাহলে ৮০ পারসেন্ট টাকা আপনার ফ্যামিলির জন্য ব্যয় হয়।
‘গত করোনা শুরুর আগে থেকে আমি বাংলাদেশে আছি। একা থাকা যে কী কষ্ট—যাঁরা একা থাকেন, তাঁরাই একমাত্র বলতে পারেন বা বোঝেন।
‘যাদের জন্য আমি বেশি করছি, প্রত্যেকটা লোকের কাছে আমি প্রতারিত হয়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল, নাম কামরুজ্জামান বাবু। আমি নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছি। সে আমার ২৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে।’
মহসিন খান আরও বলেন, ‘পিতা-মাতা যা উপার্জন করে, তার সিংহভাগ সন্তানদের পেছনে খরচ করে। প্রকৃত বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবার অনেক সময় বুঝতে চায় না। নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না। যারা দেখছেন, তাঁদের সঙ্গে হয়তো এটাই শেষ দেখা। সবাই ভালো থাকবেন।’
এরপর নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন মহসিন।