
‘কিলার রোবট’ কি ভবিষ্যৎ যুদ্ধের বড় হাতিয়ার?
যুদ্ধের নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মানব সভ্যতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের অভাবনীয় বিকাশের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন এমন সব অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে, যেগুলো কোনো মানুষের নির্দেশনা বা সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রু সেনাদের চিহ্নিত ও হত্যা করতে পারবে।
এসব অস্ত্রকে ‘স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র’ পদ্ধতি বলা হচ্ছে, যার কেতাবি নাম ‘লিথ্যাল অটোনোমাস ওয়েপনস সিস্টেম’ (এলওডব্লিউএস)। তবে সমালোচকরা এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘কিলার রোবট’। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইরান, ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া ও তুরস্ক এ ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্রের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্ক নির্মিত কারগু-২ ড্রোনটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাজ করে। ২০২০ সালে এ ড্রোন দিয়ে লিবিয়ায় হামলা চালানো হয়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেও এমন স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। মস্কো ও কিয়েভ দুপক্ষই শত্রু সেনা ও অবকাঠামো ধ্বংসে চালকবিহীন এ অস্ত্র ব্যবহার করছে। এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের এমন ব্যবহারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিশ্লেষকরা।
কিলার রোবটের এমন ব্যবহার ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টাও করা হচ্ছে। এ ধরনের যন্ত্র অস্ত্রের ব্যাপক উত্থান বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞ, অধিকার কর্মী ও কূটনীতিকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারের সম্ভাব্য সুবিধা ও ঝুঁকি নিয়ে ভাবছে এবং কীভাবে ও কখন এসব অস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার থামানো উচিত, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করছে।
তবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভূরাজনৈতিক নানা বিভক্তির কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আদৌ এই ব্যাপারে কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা বা ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্র পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় রোবটদের দখলে চলে যাওয়ার আগেই এদের থামানো উচিত। তা নাহলে ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলো হয়ে ওঠবে আরও বিভীষিকাময়।
তারা বলছেন, এ প্রতিযোগিতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর নাম করে স্বয়ংক্রিয় এ অস্ত্রের ব্যবহারে ধ্বংসের ব্যাপকতা বাড়ছে। মানব জীবনও পড়ছে হুমকির মুখে।
‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো যাবে না’
গত মার্চের শেষ দিকে লন্ডনভিত্তিক চ্যাথাম হাউসের রিসার্চ সহযোগী ইয়াসমিন আফিনা যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের দ্বিতীয় চেম্বার হাউস অব লর্ডসে বর্ণনা করেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ভুল করে আল জাজিরার এক সাংবাদিককে আল কায়েদার সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র তখন ওই সাংবাদিককে তাদের নজরদারিতেও রেখেছিল। কিন্তু মার্কিন সরকার কখনও এটি নিজে থেকে স্বীকার করেনি। মানুষ এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে ২০১৩ সালে অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা গোপন মার্কিন নথি থেকে।
আফিনা বলেন, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের ওপর যে নজরদারি করা হয়েছিল, তা হয়তো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নয়, তবে এটিও একটি ঘাতক হতে পারত। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি তখন ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে অবশ্যই তা হতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।’
সিডনির ‘ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ টবি ওয়ালশ বলেন, ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অ্যালগরিদম গাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হয়, যাতে এটি পথচারীদের পিষে না দেয়। বিপরীতে একই অ্যালগরিদম স্বয়ংক্রিয় ড্রোনে ব্যবহার করা হয় টার্গেট শনাক্ত করে তার গতিবিধি অনুসরণ করতে এবং এটি মানুষকে এড়িয়ে যাওয়া মানে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচানোর বদলে হত্যার লক্ষ্য বানায়। তাই এ প্রযুক্তি মানব সভ্যতা ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর পরমার্শ দেন তিনি।
লাভ ও ঝুঁকি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নির্ভর স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র কিছু ব্যাপারে যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন- যুদ্ধক্ষেত্রে এসব অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সেনাদের সংশ্লিষ্টতা কমানো যাবে। এতে তাদের জীবন বাঁচবে। যারা এসব অস্ত্রের সমর্থনে কথা বলছেন, তাদের যুক্তি হচ্ছে এসব জটিল ও সূক্ষ্ম অস্ত্রের সাহায্যে মনুষ্য সৃষ্ট ত্রুটি ও পক্ষপাতিত্ব এড়ানো সম্ভব হবে। লক্ষ্যমাত্রায় আরও নিখুঁতভাবে আঘাত হানা গেলে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে।
তবে অনেক বিশ্লেষক ও অধিকার কর্মীরা এসব সম্ভাবনার চাইতেও কিলার রোবটের নেতিবাচক দিকটিই বেশি গুরুত্বসহকারে দেখছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি হলে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে গভীরভাবে না জানা এসব স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র ভয়াবহ কোনো কাজ করে বসতে পারে। তার ওপর আবেগহীন কোনো যন্ত্রকে মানুষের জীবন-মৃত্যুর ফয়সালার ভার দিতেও রাজি নন তারা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয় এসব অস্ত্রের জবাবদিহিতা কে এবং কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?
২০১৯ সালে বিশ্বের ১২৬টি দেশ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝুঁকি বিবেচনায় জাতিসংঘের নিযুক্ত একদল বিশেষজ্ঞের অনুমোদিত ১১টি নীতিমালার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে। এসব নীতির মধ্যে অন্যতম ছিল, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এ জাতীয় অস্ত্রের সম্ভাব্য বিকাশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধের সময় এ আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ-যদি কোনো রোবট যুদ্ধাপরাধ করে, তাহলে কি সংশ্লিষ্ট রোবটের কমান্ডিং অফিসারকে এজন্য দায়বদ্ধ করা হবে? নাকি তারও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যারা এসব রোবটকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? না কি এসব রোবট যারা তৈরি করেছে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে?
গত মার্চ মাসে গবেষক ভিনসেন্ট বুলানিন এবং মার্টা বো স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এ ত্রুটিগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি ‘স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র ব্যবস্থা’র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞাও নেই। যদিও বেশিরভাগ দেশ একমত যে, এ ক্ষেত্রে ‘গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো সিস্টেমটি মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত, চিহ্নিত ও হামলা করতে সক্ষম হবে।’
এমনকি স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র ব্যবস্থার ‘অফিশিয়াল বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞাও নেই। যদিও বেশিরভাগ দেশ একমত যে, গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো সিস্টেমটি মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত, নির্বাচন এবং হামলা করতে সক্ষম হবে।
বুলানিন আরও বলেন, ‘আমরা একটি সম্ভাব্য ক্ষমতা সম্পর্কে কথা বলছি, একটি ফাংশনের কথা বলছি, যা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবস্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে, যা বিভিন্ন আকারে ব্যবহৃত হতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের মিশনে ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং আপনি যদি কোনো কিছু নিষিদ্ধ করতে চান, তবে আপনাকে ঠিক সেই ধরনের অস্ত্র শনাক্ত করতে হবে, যেটিকে আপনি সমস্যাযুক্ত বলে মনে করেন।’
তিনি বলেন, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে, দ্বি-স্তরের নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে তা আরও বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে। এ নীতিমালায় কিছু অস্ত্র ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং অন্যদের অনুমতি দেয়া হবে, যদি তারা নীমিতালাগুলোকে কঠোরভাবে পালন করে।
বুলানিন আরও বলেন, এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো সেই নীতিমালাগুলো কেমন হবে, যা এসব অস্ত্রের সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাস বা বন্ধ করতে পারে। আবার দেশগুলোকে সেই নীতিমালার সঙ্গে একাত্মতাও পোষণ করতে হবে।