
তিলা নাগ ইগল—দুর্দান্ত এক সাপশিকারি
এই শিকারি পাখিটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের প্রধান খাদ্য সাপ। বিষাক্ত কিংবা নির্বিশ সব ধরনের সাপই এরা ভক্ষণ করে থাকে। বিল হাওরের জলজ সাপ থেকে শুরু করে গোখরা, দাঁড়াশ কিংবা দুধরাজ, কারও এর থাবা থেকে নিস্তার নেই। নাগ-নাগিনী, অর্থাৎ সাপের দুশমন হওয়ার কারণে ওরা খ্যাতি পেয়েছে তিলা নাগ ইগল নামে। বেশ বড় আকৃতির এই পাখিকে একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই দেখা যেত। এর নানা ধরনের আঞ্চলিক নাম রয়েছে। কোথাও এরা সাপ ইগল নামে পরিচিত, কেউ বলে সাপমারা চিল, অনেকে ডাকে নাগ ইগল বলে, কারও কাছে পরিচিত তিলাবাজ নামে।
এদের ইংরেজি নাম হচ্ছে Crested Serpent Eagle এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Spilornees Cheela. এই পাখিদের গায়ের রং গাঢ় বাদামি, পেটের রং পিঠের চেয়ে হালকা। ডানা ও পেটজুড়ে রয়েছে সাদা ফোটা দাগ। এদের লেজ কালো। তবে লেজের নিচের অংশের মাঝখানের কিছু জায়গার রং সাদা। এদের দেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে এদের মাথার খোপা। এই শিকারি পাখিটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের প্রধান খাদ্য সাপ। বিষাক্ত কিংবা নির্বিশ সব ধরনের সাপই এরা ভক্ষণ করে থাকে। বিল হাওরের জলজ সাপ থেকে শুরু করে গোখরা, দাঁড়াশ কিংবা দুধরাজ, কারও এর থাবা থেকে নিস্তার নেই। নাগ-নাগিনী, অর্থাৎ সাপের দুশমন হওয়ার কারণে ওরা খ্যাতি পেয়েছে তিলা নাগ ইগল নামে। তবে এসব ছাড়া এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ, পাখি, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদি।
তিলা নাগ ইগল একা থাকতে পছন্দ করে। তবে বাসা বাঁধার আগে সঙ্গী খুঁজে নেয়। এদের প্রজননের সময় হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। বড় গাছের মগডালে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে ওরা। গাছের চিকন শুকনা ডাল সংগ্রহ করে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যে বিশাল আকারের বাসা তৈরি করে ফেলে। তিলা নাগ এত বড় পাখি কিন্তু ডিম পাড়ে মাত্র একটি। ডিমের আকার অনেকটা রাজহাঁসের ডিমের মতো। এদের বাসাটি যদি নিরাপদ স্থানে হয়, তবে এরা বছরের পর বছর ডিম পাড়ার জন্য একই বাসা ব্যবহার করে থাকে।
তিলানাগ ইগলেরা বাসা তৈরির সময় স্ত্রী-পুরুষ দুজন মিলেই কাজ করে থাকে। তবে ডিমে তা দেওয়ার কাজটি একান্ত স্ত্রী পাখিটি করে থাকে। স্ত্রী পাখিটি খাবারের সন্ধানে গেলে পুরুষ বাসার প্রহরায় থাকে। কোন কারণে এদের ডিম নষ্ট হয়ে গেলে, স্ত্রী পাখিটি দুই থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যে আরও একটি নতুন ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসার পর বাবা-মা দুজনে মিলে বাচ্চার যত্ন নিয়ে থাকে। ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। সদ্য ফোটা বাচ্চার গায়ের রং সাদাটে। দেড় মাস বয়সে বাচ্চা উঠতে শিখে। ডিম ফুটে বের হওয়া থেকে পূর্ণ বয়স পর্যন্ত এদের দেহের পালকে বেশ কয়েক ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। তিলা নাগের বাসার আশপাশে ছোট আকৃতির নানা জাতের পাখি এসে বাসা তৈরি করে থাকে। এ কাজটি তারা করে থাকে নিজেদের ডিম আর বাচ্চার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। পাখির ছানা এবং ডিমের প্রধান শত্রু হচ্ছে সাপ। কিন্তু তিলা নাগ ইগলের বাসার কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাপ নিজেই শিকারে পরিণত হবে; অন্যান্য পাখির এ কথা ভালো করেই জানা আছে।
বর্তমান সময়ে দেশে তিলা নাগ ইগলদের অবস্থা খুবই করুণ। আমার কৈশোরের সেই প্রিয় ধোপাপুর বিলকে পরিণত করা হয়েছে মাছের খামারে। একটাও জলজ উদ্ভিদ আর সেখানে অবশিষ্ট নেই। রোটেনন নামের বিষ ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয়েছে দেশীয় মাছসহ সমস্ত জলজ প্রাণী। সারা দেশেই চলছে এই অবস্থা। প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ইজারা নিয়ে শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ চাষ। এর ফলে তিলা নাগ ইগলেরা পড়েছে প্রবল খাদ্যসংকটে। খামারমালিকেরা তাদের মাছ রক্ষায় সদা তৎপর। বিগত সময়ে বন্দুক আর এয়ারগানের গুলিতে বহু তিলা নাগের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে বড় বড় গাছ কমে যাওয়া। মানুষ তাদের নিজের প্রয়োজনে একের পর এক প্রাচীন বৃক্ষ নিধন করেছে। এতে করে তিলা নাগ ইগলদের বাসা তৈরির মতো নিরাপদ স্থানের অভাব দেখা দিয়েছে। একসময় দেশের প্রতিটি বিল হাওরের পাশে তিলা নাগ ইগলের সরব উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এখন আর এদের চেহারা তেমন একটা চোখেই পড়ে না। দ্রুত কমে আসছে এদের সংখ্যা। এ অবস্থা সমান্তরালভাবে চলতে থাকতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এরা দেশের প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সুন্দর, বিশাল, সাহসী এই পাখিটি প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। একে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে সকল সচেতন নাগরিককে। পৃথিবী শুধুই আমাদের একার নয়, আমরা যেমন এখানকার বাসিন্দা, ওরাও তাই। ওদেরও আছে বাঁচার অধিকার। তাই নতুন আন্দোলনের ডাক দেওয়ার সময় এসেছে, প্রাকৃতিক জলাশয় এগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে আগের রূপে। বিল হাওরগুলো আবার যেন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে জলজ উদ্ভিদ, নানা জাতের মাছ, জলচর প্রাণী আর পাখির সমারোহে। আর তা না হলে সাজানো প্রকৃতি নষ্ট করার দায় বহন করতে হবে আমাদের সকলকে।