
লড়াইয়ে অস্বীকৃতি: সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন মিয়ানমারের সৈন্যরা
গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলন দমন আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্লান্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী সদস্যরা আর যুদ্ধ করতে চাইছেন না। দীর্ঘ লড়াইয়ের চাপে অনেক সেনাসদস্য পক্ষ ত্যাগ করছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না কেউ। সব মিলিয়ে দুই বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা মিয়ানমারের জান্তা সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে হিমশিম খাচ্ছে বলে সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন দেশটির পক্ষত্যাগী কয়েকজন সেনা সদস্য।
তেমনই একজন সেনাসদস্য নে অং (ছদ্মনাম) বলেন, “কেউই সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চায় না। মানুষ তাদের নিষ্ঠুরতা আর অন্যায় আচরণকে ঘৃণা করে।” নে অং দুইবারের চেষ্টায় সেনাবাহিনী থেকে পালাতে সক্ষম হন। প্রথম দফায় ঘাঁটি থেকে পালানোর সময় ধরা পড়ে গেলে তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটানো হয়েছিল। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তিনি সফল হন এবং সরকারবিরোধীদের সহায়তায় সীমান্ত পেরিয়ে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান। তিনি বলেন, আমার এক বন্ধু আছে বিরোধীদের আন্দোলনে। আমি তাকে বলার পর সে আমার বিষয়টি থাইল্যান্ডের সহযোগীদের জানায়। পরে তাদের সহায়তায় আমি এখানে পৌঁছাতে পারি।
নে অং এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ত্যাগ করা আরো একশ সেনাসদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে থাইল্যান্ডের একটি নিরাপদ স্থানে আছেন। তারা নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে অস্বীকার করায় এবং বর্তমানে আত্মগোপনে থাকায় বিবিসি তাদের আসল নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি। এসব সেনাকে যাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই আন্দোলনকারীরাই তাদেরকে বাসস্থান আর সুরক্ষা দিচ্ছে।
মিয়ানমারের নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্টের (এনইউজি) তথ্যের বরাতে বিবিসি বলছে, ২০২১ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর দেশটির ১৩ হাজার সেনা ও পুলিশ সদস্য দেশত্যাগ করেছেন। আরো সেনা যাতে পক্ষ ত্যাগ করেন, সেজন্য নগদ অর্থের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ডের আশ্রয়ে আসা সবচেয়ে কমবয়সী সেনাদের একজন মং সেইনের বয়স এখন ১৯ বছর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মং বলছেন, সামরিক বাহিনীর জীবন তার ভালো লাগত। সেইসঙ্গে নিজের পরিবারকেও তিনি ‘গর্বিত’ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশজুড়ে গণতন্ত্রকামী আন্দোলনের ওপর সামরিকবাহিনীর নির্মমতা দেখে সামরিক উর্দিধারীদের বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। “অনলাইনে আমি দেখেছি লোকজন আমাদেরকে ‘সামরিক কুকুর’ বলছে। বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়।” মিয়ানমারে ‘কুকুর’ বলাটা চরম অপমানের বলে জানান তিনি।
মং সেইন জানান, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা এবং গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে ‘ওপরের নির্দেশ’ অমান্য করার সুযোগ নেই তার মত পদাতিক সেনাদের। তারপরও তিনি বাহিনী ত্যাগ করেছেন, কারণ তার ধারণা, সামরিকে বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) নামে পরিচিত বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্কের পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো অনেকের ধারণার চেয়ে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এদের সঙ্গে লড়াইয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে। দেশটির মাগওয়ে এবং সাগাইং বিভাগ থেকে একসময় সামরিক বাহিনীতে প্রচুর জনবল নিয়োগ করা হলেও এখন এই দুটি স্থানের তরুণরা মিলিশিয়া গ্রুপগুলোতে যোগ দিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।
১৮ বছর মিয়ানমার বিমানবাহিনীতে কাজ করা ক্যাপ্টেন জেই থু অং অভ্যুত্থানের এক বছর পর ২০২২ সালে পক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্তমান অবস্থার বর্ণনায় তিনি বিবিসিকে বলেন, “তারা সারাদেশেই হামলার মুখে রয়েছে। পাল্টা আঘাত করার মত পর্যাপ্ত জনবলও নেই তাদের।”
এ কারণেই দেশটির সামরিকবাহিনী বিমানশক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতেও দেশেটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। জানুয়ারি থেকে কমপক্ষে ২০০টির বেশি বিমান হামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি হামলাটি চালানো হয় গত এপ্রিলে সাগাইং অঞ্চলের পা জি গাই গ্রামে। সেখানে বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ ১৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। “বিমান বাহিনী ছাড়া মনে হয় সামরিক বাহিনী ভেঙে পড়বে,” বলেন ক্যাপ্টেন অং।
অং যখন বিমান বাহিনীর ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন, সামরিক বাহিনী ছেড়ে পালানো অন্যদের মত তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই তাকে নিয়েও গর্বিত হয়েছিল। তার ভাষ্য, সে সময় মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়াটা ছিল অনেক সম্মানের। “কিন্তু অভ্যুত্থান আমাদেরকে অতল গহ্বরে টেনে নামিয়েছে। বিমান বাহিনীতে আমি যাদের সঙ্গে ছিলাম, তারা সবাই খারাপ ছিল না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে তারাই দানবের মত আচরণ করতে শুরু করে,” বলেন তিনি। অংই একমাত্র সদস্য যিনি তার ইউনিট থেকে পালিয়েছেন। “আমার বেশিরভাগ বন্ধুই আমার জনগণের বিরুদ্ধে এখনো যুদ্ধ করছে।”