দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রকল্প ঢাকা-সিলেট ৬ লেন মহাসড়ক প্রকল্প। প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনেক নাটক হয়েছে। শুরুর আগেই বার বার আটকে যায় এই প্রকল্প। এছাড়া প্রকল্প নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এ কারণে প্রকল্পের অনেক গল্পই ছিল আড়ালে। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর সার্বিক বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অনেক তথ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে-প্রকল্পের মেয়াদ অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অনেক জায়গায় এখনো ভূমি অধিগ্রহণই করা হয়নি। এ কারণে প্রকল্প নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি’র)-এর অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। ৬ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও চলতি নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ১১ ভাগ। ঠিকাদারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো জায়গা না পাওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। প্রকল্প সূত্র জানায়- দেশি-বিদেশি জয়েন্টভেঞ্চার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৪-২০১৫ সালে এ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি ও ডিটেইল্ড ডিজাইন সম্পন্ন হয়।
২০২০ সালের আগে সম্পাদিত ডিজাইনের ডিজাইন রিভিউ সম্পন্ন হয়। এতে ব্যয় হয় ২০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিংয়ের জন্য একটি পৃথক সহায়ক প্রকল্প অনুমোদিত হয়। নির্মাণ প্রকল্পের আগে ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিংয়ের সহায়ক প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল সড়ক উন্নয়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের আগেই ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিং কাজ শেষ করা যাতে ঠিকাদাররা কার্যাদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে এবং যথাসময়ে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের অধীনে ঠিকাদার নিয়োগের দেড় বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিং কাজ সমাপ্ত হয়নি। ঢাকা-সিলেট সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে ১৩৭৯ একর।
সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৬,৯১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবি দেবে ১৩,২৪৫ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকার দেবে ৩৬৭৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৪ঠা অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য লোনচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও প্রায় ১৮ মাস পর দেশের অন্যতম মেগা ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের পহেলা মার্চ ঢাকার কাঁচপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পের শুরুতেই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে সূত্র জানায়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন-কার্যাদেশ পেয়ে সবকিছু নিয়ে সাইট অফিস স্থাপন করে বসে আছি। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে জমি বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট এই ৭টি জেলায় মোট ৬৬টি এলএ কেসের অধীনে ৮২৯ দশমিক ৮৩৪১ একর ভূমি অধিগ্রহণ অন্তর্ভুক্ত। সিলেট জেলায় আরডিপিপি অনুসারে ভূমির পরিমাণ ২৭৯ দশমিক ৬ একর দাখিলকৃত এলএ প্রস্তাব সংখ্যা ১৭টি, এলএ প্রস্তাব অনুসারে ভূমির পরিমাণ ২৫৪ দশমিক ৯৫৪৮ একর।
প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ প্রকল্পে ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ১৩টি লটে কাজ শুরু হয়েছে। ১১নং লটে প্রকল্প এরিয়া সদরঘাট নতুন বাজার মসজিদ থেকে শেরপুর টোলপ্লাজা পর্যন্ত। এই অংশে ৫টি সেতুর টেস্ট পাইল সম্পন্ন হয়েছে। এই অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। ১২নং লটে প্রকল্প এলাকা হচ্ছে- শেরপুর টোল প্লাজা থেকে কাশিকাপন বাজার পর্যন্ত। এখানে কাজ হচ্ছে ৬টি সেতুর মধ্যে ৫টি সেতুর নির্মাণকাজ চলমান, ১০টি কালভার্টের মধ্যে ৪টি কালভার্ট নির্মাণ চলমান, ২ কিলোমিটার অংশে মাটি ভরাট কাজ চলমান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইএনইজেড এবং টিসিসিএল জয়েন্টভেঞ্চার। তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০২৩ সালের পহেলা মার্চ। ১২নং এর (এ) লটে কাশিকাপন বাজার থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার লালাবাজার পর্যন্ত। এই অংশে কাজ হচ্ছে ১৫টি কালভার্টের মধ্যে ১০টি কালভার্ট নির্মাণ চলমান, ৪৫০০ মিটার অংশে মাটি ভরাট কাজ চলমান। এই অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়নার সিনো হাইড্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো ৮ কর্পোরেশন লিমিটেড। তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয় গত বছরের মে মাসে। ১৩নং লটে কাজের এরিয়া সিলেটের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার লালাবাজার থেকে সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের পীর হাবীবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেডজেডএইচই ও এমআইএল জয়েন্ট ভেঞ্চার। এই অংশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাইটে এসে প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও সড়কের মূল কাজ এখনো শুরু হয়নি। ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একে মোহাম্মদ ফজলুল করীম জানিয়েছেন-প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাজের সাইটে এসে কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেছে কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এই পর্যন্ত ১১ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন-বিদ্যমান এমন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সময় বৃদ্ধি ও ক্ষতি পূরণ প্রদানের জন্য ক্লেইমের চিঠি দেয়া শুরু করেছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারলে এডিবিকে কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হবে। সিলেটে কার্যাদেশ প্রাপ্ত চায়না কোম্পানি সিনো হাইড্রো এর এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৩ সালের মে মাসে তারা জনবল নিয়ে সিলেট এসেছেন কিনু্ত জায়গা না পাওয়ায় সড়কের কাজ বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। বর্তমানে একরকম অলস সময় পার করছেন বলেও জানান চীনা ওই কর্মকর্তা।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুুব মুরাদ জানিয়েছেন-সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের সিলেট অংশের ভূমি অধিগ্রহণে জন্য ১৪-২২-২৩ এলএ কেস ছাড়া সব কেসে ৪ (১) ধারার নোটিশ জারি করা হয়েছে। সিলেট জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সিনিয়র সহকারী কমিশনার তমালিকা পাল রয়েছেন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কাজে। মূলত তার কারণেই সিলেট অংশে ভূমি অধিগ্রহণে ধীরগতি হচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে প্রকল্পের কাজ ধীরগতি হওয়ার রাজনৈতিক মহলেও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানিয়েছেন-দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় সিলেট থেকে কিন্তু সিলেটের উন্নয়ন সব সময় তলানিতে থাকে। বিগত ১৫ বছরে সিলেটের তেমন উন্নয়ন হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন- ঢাকা-সিলেট সড়ক উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও এই পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি খুবই নগণ্য। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিদ্যমান এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি জানান।
জামায়াতে ইসলামী সিলেট জেলা আমীর মাওলানা হাবীবুর রহমান জানিয়েছেন-সিলেটের মানুষ ঢাকা-সিলেট ৬ লেন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রজেক্ট এই প্রজেক্টের পরে শুরু হয়েও ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিনু্ত ঢাকা সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটিতে মাত্র ১০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ লাগবে উল্লিখিত প্রকল্প দ্রুত শেষ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।সুত্র: মানবজমিন