সিলেটে বন্যা: আশ্রয়কেন্দ্রে তীব্র খাদ্য সংকট
সিলেটের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পাঁচদিন ধরে আটকে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। অধিকাংশ ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুই ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছেন সিলেটের প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন তীব্র খাবার সংকটে। এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজে আছে। সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।
এর মধ্যে নেই বিদ্যুৎ, মুঠোফোনগুলো বন্ধ। এমন ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায় ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও বেসরকারীভাবে দেওয়া ত্রাণ অপ্রতুল বলছেন বন্যাদুর্গতরা। খাদ্য সংকটে অভুক্ত রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা ৩১ হাজার গৃহপালিত পশুও।
এদিকে বন্যার পানি তেমন কমছে না। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে পানি কমেছে মাত্র দশমিক ১ সেন্টিমিটার। আর একই সময়ে সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্ট কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়েছে দশমিক ৯ সেন্টিমিটার। বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় আতঙ্কে আছেন লোকজন। এছাড়া নগরের ফাঁকা বাসাবাড়িতে চুরি ও ডাকাতি বেড়েছে।
এমন অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন নগরের বাসিন্দারা। এখন আর নগরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খালি নেই। সবজায়গায় লোকজনে টই-টম্বুর। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বন্যাদুর্গতরা চাইলেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। অতিরিক্ত পানি থাকায় তারা বাসাবাড়ির সিঁড়িতে এমনকি বাসার ছাদেও ত্রি-পল টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
সিলেট উপশহরের বাসিন্দা নিতেশ সরকার বলেন, আগের কিছু চাল ছিল, আর সামান্য কিছু বাজার করতে পেরেছি। দোকানপাট সব বন্ধ। পানিতে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় চলাচলেও সমস্যা হচ্ছে। ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্যে আছি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, খাদ্যের জন্য মানুষের হাহাকার দেখলে কষ্ট লাগে। আমাদের এখন আর কিছু করার নেই। আমি নিজেও বন্যায় আক্রান্ত। এছাড়া দোকানপাট বন্ধ থাকায় শুকনো খাবারও কেনা যাচ্ছে না। গৃহপালিত পশু নিয়েও মানুষ বিপদে আছেন। গোখাদ্যের খুবই অভাব। মানুষ-পশু সবাই খাদ্য সংকটে আছি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এলাকায় ত্রাণ সহয়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
গত বুধবার (১৫ জুন) বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির পর থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত মহানগরসহ ১৩টি উপজেলায় ৬১২ মেট্রিক টন জিআর চাল, ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৭ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চারটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ১৪০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। সেনাবাহিনীর ১৩টি ইউনিট ৬০টি বোট দিয়ে বন্যাতর্দের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসাসেবা, খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্ব) রুহুল আলম বলেন, নগরে নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্র খোলার উপযোগী স্থান আর নেই। তবে আশ্রয়কেন্দ্রের চাহিদা রয়েছে। এখন বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটগুলোতেও লোকজন জায়গা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও বহুতল ভবনের খালি জায়গায় ১৫-২০টি পরিবারকে জায়গা করে দিয়ে একেকটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছেন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার এহসানুল আলম বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই মুহূর্তে জিআরের কোনো চাল মজুত নেই। শুকনো খাবার ২১৮ প্যাকেট ও ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতে আছে। আরও ত্রাণ আসছে। সরকার বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে রয়েছে। বন্যা আক্রান্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে সিলেট আসছেন। ওই সময় তিনি বন্যার্তদের মাঝে বিপুল পরিমাণ শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবেন।
তিনি আরও বলেন, রোববার পর্যন্ত সিলেটের মোট ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ৩১ হাজার গবাদিপশুকেও উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির পর থেকে রোববার পর্যন্ত মহানগরসহ ১৩টি উপজেলায় ৬১২ মেট্রিক টন জিআর চাল, ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৭ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।