পদ্মা সেতু নির্মাণে যত কাঁটা
পদ্মা সেতু আজ আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবতা। স্বপ্নের বাস্তবায়ন। শনিবার (২৫ জুন) দেশের কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত এ সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতু। তবে সেতু নির্মাণের পথটি মসৃণ ছিল না। কাঁটায় ভরা পথ পেরিয়ে তবেই বাস্তবে রূপ পেয়েছে পদ্মা সেতু। নানান প্রতিবন্ধকতা পেরুতে হয়েছে প্রকল্পটিকে। কী ছিল সেসব প্রতিবন্ধকতা? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
কথিত দুর্নীতির অভিযোগ
নবম সংসদ নির্বাচনের (২০০৮) আগে ‘দিন বদলের সনদ’ নামে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। ক্ষমতায় আসার পর সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে সরকার। তবে কাজ শুরুর আগেই ওঠে দুর্নীতির কথিত অভিযোগ। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। বিদেশি অর্থায়ন নিয়ে চলে নানা জটিলতা। এক পর্যায়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র
শুরুতেই পদ্মা সেতু নির্মাণে হোঁচট খাওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা হয়। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দোষারোপ করা হয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্বকে। এছাড়া দেশীয় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে।
মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক। ঋণচুক্তির পাঁচ মাসের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে ২০১১ সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়ে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম আসে।
বার বার পিছিয়েছে
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বার বার পিছিয়েছে এর কার্যক্রম। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। ২২টি খুঁটির (পিলার) পাইলিংসংক্রান্ত নকশা সংশোধন, নদীশাসন কাজে বিলম্ব এবং নদীভাঙন ও প্রবল স্রোতের কারণেও কাজ পিছিয়েছে।
ব্যায় বেড়েছে তিনগুণ
পদ্মা সেতু নির্মাণে শুরুতে ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও সর্বশেষ তা তিনগুণ বেড়ে ব্যয় আপাতত দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। ২০০৭ সালে একনেক ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েক দফা নকশা পরিবর্তনে এর দৈর্ঘ্য ও ব্যয় বাড়তে থাকে।
এছাড়া বাড়তি সময় ভারী যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে পড়ে থাকার কারণে বাড়তি খরচ চাইছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমন তিন শতাধিক দাবি (ক্লেইম) আছে ঠিকাদারের। এগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। একইভাবে নদীশাসন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকেও নদীর তলদেশে ৩০ লাখ বালুর বস্তা ফেলার খরচ দিতে হবে। নদীভাঙন মেরামতেরও খরচ চাইছে তারা।
বছর বছর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে ঠিকাদারকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ধরা আছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ টাকায় কুলাবে না বলে মনে করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
এছাড়া ঠিকাদারের ভ্যাট ও আয়কর ৪ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ১০ শতাংশ। দেশীয় পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ২ শতাংশ। এ তিন খাতে ভ্যাট ও কর বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৮৬ কোটি টাকা। এগুলো সামনে যোগ করতে হবে।
গ্যাসলাইন বসানো বাবদ যে খরচ ধরা হয়েছে, তা থেকে কিছু টাকা বেঁচে যাবে। তবে ৪০০ কেভি বিদ্যুতের লাইন বসানোর কাজে ব্যয় বাড়বে। ইতোমধ্যে যেসব খরচ বেড়েছে, সামনে যা বাড়বে, সব মিলিয়ে আরেক দফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।
এত কিছুর পরও অবশেষে আলোর মুখে দেখেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এখন নির্বিঘ্নে সেতুটি চালু হওয়ার অপেক্ষা।