মিখাইল গর্বাচেভ: নন্দিত ও নিন্দিত
সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক মিখাইল গর্বাচেভকে একটি মিশ্র বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধী পশ্চিমা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে তিনি পেতেন ভালোবাসা। অন্যদিকে সাত দশকের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য বহুসংখ্যক রুশ নাগরিক তাকে তিরস্কার করতেন। এর নেপথ্যে তার সংস্কারনীতিকে দুষতেন তারা। তার উদার ও সংস্কারনীতির ফলে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির ভেতরে যে স্বাধীনতাকামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি জেগে উঠেছিল তাতে ভয়াবহ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা কমিউনিস্ট ফেডারেশনটিতে। তারা এ জন্য গর্বাচেভকে কখনই ক্ষমা করেননি।
তার নেয়া ‘গ্লাসনোস্ট’ বা খোলামেলা অথবা উদারপন্থি নীতির ফলে রুশ নাগরিকরা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অতিমাত্রায় স্বাধীনতা উপভোগ শুরু করেন। কিন্তু অনেকের মতে, তার শাসনামলে জীবনযাত্রার মান নেমে গিয়েছিল তলানিতে।
যাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি প্রীতি রয়েছে তারা গর্বাচেভকে সাত দশকের সেই কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের ধ্বংসকারী হিসেবে দেখেন। জাতীয়তাবাদীদের উৎসাহিত করে তার এমন সংস্কারনীতিগুলোকে দায়ী করেন তারা। এতে করে বাল্টিক প্রজাতন্ত্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ব্লকের অনেকাংশে জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠে। ভিত নড়ে যায় স্নায়ুযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের।
২০২১ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি রুশ নাগরিক মত দিয়েছেন, গর্বাচেভের শাসনামলে তাদের দেশ ভুল পথে পরিচালিত হয়। গত শতাব্দীতে দেশটির সবচেয়ে অজনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। রাষ্ট্র পরিচালিত জরিপ পোলস্টারে এমনটি উঠে আসে।
গর্বাচেভ কখনই সমালোচনাকে উড়িয়ে দিতেন না। তিনি যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অনেক নাগরিকই তাকে অপছন্দ করেন। তাদের অনেকেই ভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব খুঁজছেন।
আক্ষেপ করে গর্বাচেভ একবার বলেছিলেন, ‘একজন জারকে (রুশ শাসক) অবশ্যই জারের মতোই (একনায়কতান্ত্রিক) আচরণ করতে হয়। আমি কীভাবে তা করব, তা জানি না।’
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে গর্বাচেভের সম্পর্ক অনেকটাই তিক্ত ছিল।
২০১৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে গর্বাচেভ পুতিনের তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। সেই সঙ্গে দুই দশক ক্ষমতায় থাকা পুতিনের নীতিগুলোকে ‘প্রগতির পথে বাধা’ বলে অভিহিত করেছিলেন গর্বাচেভ।
পরোক্ষ জবাবে পুতিন জানান, মিখাইল গর্বাচেভের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বর্তমান রাশিয়ার জন্যে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’ ছিল।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, গর্বাচেভের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট এবং সকালে তার পরিবারের কাছে একটি শোকবার্তা পাঠাবেন।
গর্বাচেভের মৃত্যুতে রাশিয়ায় অবদমিত ও নিপীড়িত উদারনীতির অনুসারীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই রাশিয়ায় ইউক্রেন হামলার পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
গর্বাচেভের মৃত্যুর খবরে বিভিন্ন মাধ্যমে শোকবার্তা দিচ্ছেন হাজারো মানুষ।
জ্যেষ্ঠ রুশ সাংবাদিক মিখাইল ফিশম্যান লিখেছেন, ‘গর্বাচেভ একজন উচ্চস্তরের রাজনীতিবিদ… রাশিয়ায় আশির দশকের শেষের দিকে এবং নব্বই দশকের শুরুর দিকে নাগরিকদের যে ধরনের বাকস্বাধীনতা ছিল তা আগে কখনো চিন্তাও করা যায়নি। এটি গর্বাচেভের শাসনামলে সম্ভবপর হয়েছে। এটি তার যোগ্যতায় সম্ভবপর হয়েছে।’
‘গর্বাচেভের মৃত্যুতে আমরা সবাই এতিম হয়ে গেছি। কিন্তু সবাই এখনও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারিনি,’ এমনটি বলেছেন তার বন্ধু ও একো মস্কভি রেডিও স্টেশনের সাবেক প্রধান আলেক্সি ভেনেডিক্টভ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের খবর প্রচারের জেরে এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
রাশিয়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতা শুরু করার পেছনে গর্বাচেভের অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী গর্বাচেভ পুরস্কারের অর্থের একটি অংশ ব্যবহার করেছিলেন নোভায়া গাজেটা পত্রিকা চালু করতে। পরবর্তী সময়ে এটি দেশের সবচেয়ে প্রশংসিত স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছিল।
পত্রিকাটি রাশিয়ার অন্ধকার যুগের ওপর আলোকপাত করেছিল, প্রকাশ করেছিল চাপা পড়া বিভিন্ন খবর।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর নোভায়া গেজেটাও তাদের প্রকাশনা কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
খুব কম মানুষেই গর্বাচেভকে তার জীবনীকার উইলিয়াম টবম্যানের চেয়ে বেশি জানতেন। তিনি ২০১৭ সালে লিখেছিলেন, উদারপন্থি গর্বাচেভের মূল চ্যালেঞ্জটি ছিল নাগরিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিতে যেসব নীতিমালা ও প্রস্তাব তিনি উপস্থাপন করেছিলেন তা অনুধাবনের সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না রুশদের।
গত ৩০ জুন হাসপাতালে গর্বাচেভের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করেছিলেন উদারপন্থি অর্থনীতিবিদ রুসলান গ্রিনবার্গ।
গ্রিনবার্গ তার পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার পরে বলেন, ‘মিখাইল গর্বাচেভ আমাদের যেসব স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, দুর্ভাগ্য আমরা অনেকে বুঝে উঠতেও পারিনি কীভাবে সেগুলোকে কাজে লাগানো যেত।’