ভোটের আগে সংঘাতময় বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ
# ৭ মাসে সহিংসতায় নিহত ৫০, আহত ৩১৬৪
# ১০ দিনে বিএনপির ৩ কর্মী নিহত, আহত ২ হাজার
# পাড়ায় মহল্লায় হচ্ছে বিরোধী নেতাকর্মীদের তালিকা
# প্রতিহিংসার রাজনীতি ত্যাগ করার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘাতময় হয়ে উঠেছে দেশের বাংলাদেশের রাজনীতি। গত ২২ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে বিএনপির লাগাতার কর্মসূচি চলছে। গত রোববার পর্যন্ত ৪১টি সমাবেশে হামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। সংঘর্ষে তিনজন নেতাকর্মী নিহত ও ২ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে দলটি।
এদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি সহিংসতার চেষ্টা করছে। তারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে বাধ্য করছে পুলিশ প্রশাসনকে অ্যাকশনে যেতে। আর পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেউ সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করলে, জনগণের জানমাল রক্ষা করতে যা করনীয় তাই করা হবে।
আর বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে না বেরিয়ে আসতে পারলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও রক্তক্ষয়ী ও সংঘাতময় হয়ে উঠবে।
সংঘাতময় রাজনীতি
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভোলায় দুই নেতা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে গত ২২ আগস্ট তৃণমূলে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কর্মসূচির প্রথমদিনেই ফেনীতে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর বাড়িতে হামলার অভিযোগ উঠে। এছাড়া বরিশালের গৌরনদী ও জামালপুরের মাদারগঞ্জে বিএনপির কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
একইদিন ফেনীর পরশুরাম ও পটুয়াখালীর দুমকিতে একই স্থানে দুদলের কর্মসূচি থাকায় স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। ২৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও ও টাঙ্গাইলে সমাবেশে হামলা চালানো হয়। এতে অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন।
২৬ আগস্ট বাঁশখালি, নোয়াখালীসহ দেশের ১০ জেলায় হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। ৩০ আগস্ট ফেনীর দাগনভূঁইয়ায় সমাবেশে যাওয়ার পথে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। ১ সেপ্টেম্বও নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে র্যালি চলাকালে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় গুলিতে নিহত হন যুবদলকর্মী শাওন।
৩ সেপ্টেম্বর ঠাকরগাঁও ও কিশোরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর বরগুনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হন। একইদিন ফরিদপুরে বিএনপি, পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হন।
শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, গত কয়েকদিনে ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের কোন্দলেও একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ৪ সেপ্টেম্বর ক্যাফেটেরিয়ায় তালা দেওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ। সংঘর্ষকালে গুলিবিনিময় ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় এক সাংবাদিক ছাড়াও দুই পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন।
একইদিন কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সংসদ সদস্য জাফর আলমের অনুসারীদের বিরুদ্ধে এক নেতাকে পেটানোর অভিযোগ উঠে। মারধরের শিকার আওয়ামী লীগের নেতার নাম মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
৭ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৫০, আহত ৩১৬৪
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২২ সাল) জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে ২৮০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫০ জন। এসব ঘটনায় ৩ হাজার ১৬৪ জন আহত হন।
এর আগে ২০২১ সালে সারা দেশে ৯৩২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৫৭ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৮৩৩ জন আহত হন। করোনা মহামারীর সময় ২০২০ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা তুলনামূলক কম ছিল। বছরটিতে ১৫৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৩১ জন মারা যান, আহত হন ১ হাজার ৮৫৯ জন। ২০১৯ সালে ২০৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মারা যান ৩৯ জন। ২ হাজার ৬৮৯ জন আহত হন। এর আগে ২০১৮ সালে ৭০১টি সহিংসতার ঘটনায় ৬৭ জন নিহত এবং ৭ হাজার ২৮৭ জন আহত হন।
১০ দিনে বিএনপির ৩ নেতাকর্মী নিহত, আহত ২ হাজার
এদিকে গত ২২ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজেদের কর্মসূচিতে নিহত, আহত, গ্রেফতার ও ভাঙচুরের ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে গত রোববার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই দশদিনে সারা দেশে বিএনপির তিন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। গ্রেফতার হয়েছেন দু’শর বেশি নেতা-কর্মী। সারা দেশে চার হাজারের বেশি বিএনপির নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার।
বিএনপি অ্যাকশনে যেতে বাধ্য করছে, দাবি আ’লীগের
এদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি সহিংসতার চেষ্টা করছে। তারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে বাধ্য করছে পুলিশ প্রশাসনকে অ্যাকশনে যেতে। রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি গায়ে পড়ে আক্রমণ করব না। কিন্তু আমি যদি তাদের দ্বারা আক্রান্ত হই, তখন নিজেকে রক্ষা করতে পাল্টা জবাব দিতে হবে। আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ জবাব দেবে।’
অন্যদিকে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশ বিএনপিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আজ থেকে আমরা মাঠে থাকবো। নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের জবাব দেব। বিএনপি যদি জনগণের জানমালের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে যুবলীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী রাজপথে থেকে তার দাঁতভাঙা জবাব দেবে।’
পাড়ায় মহল্লায় বিরোধী নেতাকর্মীদের তালিকা হচ্ছে
রাজধানীতে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের তালিকা তৈরি করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ঢাকার প্রতিটি থানা ও পাড়া-মহল্লাভিত্তিক নেতা-কর্মীর নাম-ঠিকানা; বিভিন্ন কমিটিতে পদ, পদবি ও মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে তালিকা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই তালিকা করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে কেউ যাতে নাশকতা চালাতে না পারে, আবার নাশকতার কোনো ঘটনা ঘটলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে জন্যই এই তালিকা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, কোন থানায় বা পাড়া মহল্লায় কারা বসবাস করেন, সেটা রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাদের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে তালিকা করতে বলা হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দলের নতুন নতুন কমিটি হচ্ছে। সেসব থানা পুলিশের অবগত থাকা দরকার। এটা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রুটিন ওয়ার্ক।
যদিও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন, বিরোধী দলকে দমনপীড়ন, নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় এবং মামলার আসামি করার জন্য নির্বাচনের আগে এই তালিকা করা হচ্ছে।
প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে
রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিহিংসা ত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়ে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার খোলাকাগজকে বলেন, দেশে যা হচ্ছে এটাকে রাজনীতি বলা যায় না। এটা অপরাজনীতি। বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি তা মোকাবেলা করতে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও বাহাসে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমাদের জন্য ঘোর অন্ধকার অপেক্ষা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন রাজনীতিতে আমরা প্রতিহিংসার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন যত কাছাকাছি আসবে ততই এটা বাড়তে থাকবে। সংঘাত হলে সাধারণ মানুষ ভুগবে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তো জনগণের কথা ভাবছে না, ভাবলে এ অবস্থার সৃষ্টি হত না। আশা করি সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হবে।