প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কী পেল বাংলাদেশ
ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ঘিরে কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। আর তাই সময়ের হিসাবে সফরের বেশ কয়েক ঘণ্টা বাকি থাকলেও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, এবারের সফরটি অন্য সফরের চেয়ে ভিন্ন। কেননা এবার প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য অনেক অর্জন নিয়েই ঢাকা ফিরছেন শেখ হাসিনা।
এবারের সফর নিয়ে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে ভারত জানিয়েছে, দেশটির সব বন্দর, সড়ক, নৌপথ ব্যবহার করে বিনা মাশুলে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের জন্য বহুল কাঙ্ক্ষিত। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিটের ভারতীয় এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর বাইরে ভারত বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পোশাক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটির প্রস্তাব দিয়েছে, যা দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ট্রাকে করে ভারতে প্রবেশ করবে রপ্তানি পণ্য। এরপর ট্রেনে করে তা যাবে সমুদ্র বন্দরে। সেখান থেকে জাহাজে করে পণ্য যাবে ইউরোপ বা আমেরিকার বন্দরে।
কী পেল বাংলাদেশ, কী নিল ভারত
দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠক নিয়ে বুধবার বাংলাদেশ ও ভারত এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। ৩৩টি অনুচ্ছেদের এই বিবৃতিতে বলা হয়- রাজনীতি, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, সংযুক্তি, পানিসম্পদ, উন্নয়ন-সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও জনগণের মেলবন্ধনসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় দুই শীর্ষ নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন। দুই পক্ষ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হন।
দুই শীর্ষ নেতা পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, অন্তর্জাল নিরাপত্তা, তথ্য যোগাযোগ, মহাকাশপ্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব ও সুনীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) মতো নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারি ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির দরুন সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তারা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও অংশীদারিত্বের চেতনায় ব্যাপক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক রেল, সড়ক ও অন্যান্য সংযুক্তির বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ভারত থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত নিজেদের জোগানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক আশ্বাস দিয়েছে। এ লক্ষ্যে ভারত সব রকম প্রয়াস চালাবে।
বাংলাদেশ-ভারতের এই দুই শীর্ষ নেতা সীমান্ত-হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। তারা দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিস্তার রুখতে তাঁদের জোরালো অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
পানিসম্পদ বণ্টনে সহযোগিতার অংশ হিসেবে দুই শীর্ষ নেতা কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সেচের প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নিয়ে ফেনী নদীর অন্তর্বর্তী চুক্তি সইয়ের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা অন্তর্বর্তী চুক্তি সইয়ের রূপরেখা তৈরি এবং তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের লক্ষ্যে বাড়তি কয়েকটি নদী যুক্ত করতে যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে গঙ্গার পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে যৌথ সমীক্ষার জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতের আলোচনাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে তিস্তার অন্তর্বর্তী পানি চুক্তি সইয়ের জন্য বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল ২০১১ সালে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের ফলাফলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির পরিমাণটা এবার কম। যে সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ কোনো চুক্তি নয়। তিস্তাচুক্তি বা সীমান্ত হত্যা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিস্তার বিষয়টি ২০১১ সাল থেকেই ঝুলে আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১১ সালে ভারত তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার করতে সম্মত হয়েছিল এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি ধরে রেখেছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কঠোর বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি হয়নি। সে চুক্তি নিয়ে নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিলেও খুব একটা লাভ হবে না, কারণ মমতা ব্যানার্জি সম্মতি না দিলে তিস্তাচুক্তির সমাধান হবে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। জাতিসংঘে ভারত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে হয়তো সমাধান হতে পারে। এছাড়া সীমান্ত হত্যা বন্ধের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। অর্থাৎ শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনায় দেশের মেজর ইস্যুগুলো নিয়ে সমাধান হয়নি।’
তবে একটি সফরে সবকিছু আশা করাও ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। তার মতে, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের উন্নতি বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় সফর বেশি করা উচিত। যেন চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি আরো স্বচ্ছ হয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, একটি সফরে সব সংকট সমাধান হবে, বিষয়টি তা নয়। পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হলেও কুশিয়ার নদী ছাড়া অন্য নদীর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অপরদিকে ভারত ফেনী নদীর পানিও চেয়েছে।
‘তবে আমরা জ্বালানি বিষয়ক সহায়তা পেয়েছি। ভারত থেকে আমরা ডিজেল ও গ্যাস কিনতে পারব। খাদ্যপণ্য আমাদানিতেও আমরা ছাড় পাব। তবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর সমাধান তেমন হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক আরো দৃঢ় করা উচিত, যেন ভবিষ্যতে দুই দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করা সহজ হয়।’ বলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।
চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। মঙ্গলবার নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি শীর্ষ বৈঠক করেন। এর আগে মঙ্গলবার সকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান নরেন্দ্র মোদি। আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয় গার্ড অব অনার।