যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী: যেসব কারণে এই ঋষি সেই ঋষি নন
ঋষি সুনাকের নাটকীয় উত্থানের পেছনে যেমন আছে মেধা ও নিষ্ঠা, তেমনই আছে অভিবাসী পিতা–মাতার সযত্ন নজর এবং অল্প বয়সেই বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া।
ভারতে ব্রিটিশরাজের শাসন অবসানের ৭৫ বছর পর একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত খোদ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এ অঞ্চলে এবং তার বাইরে বিশ্বের নানা প্রান্তে বিপুল আগ্রহ ও উৎসাহ তৈরি হয়েছে। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বুহারি যেমন বলেছেন ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ২৪০ কোটি মানুষের কমনওয়েলথে তরুণদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করবে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক কীভাবে বা কোন যোগ্যতায় এমন চমক দেখাতে সক্ষম হলেন, তা নিয়েও চলছে নানা ধরনের আলোচনা, বিতর্ক ও বিচার-বিশ্লেষণ। তাঁর ৪২ বছরের জীবনকাহিনি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনায় অবশ্য যা দেখা যায় তাতে বলতেই হয়, এই ঋষি সেই ঋষি নন। বরং তাঁর নাটকীয় উত্থানের পেছনে যেমন আছে মেধা ও নিষ্ঠা, তেমনই আছে অভিবাসী পিতা–মাতার সযত্ন নজর এবং অল্প বয়সেই বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া। বস্তুত ঋষি ব্রিটেনের রাজার চেয়েও ধনী এক প্রধানমন্ত্রী।
ঋষি সুনাক নিজের ব্রিটিশ পরিচয় সম্পর্কে ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আমি আদমশুমারিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশের ঘরটিতে টিক চিহ্ন দিই। আমি পুরোপুরি ব্রিটিশ, এটি আমার জন্মভূমি, এটি আমার দেশ। তবে আমার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে ভারতীয়, আমার স্ত্রী ভারতীয়। আমি একজন হিন্দু এবং এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক নেই।’
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নন কেন?
ভারতের সঙ্গে তাঁর বংশগত যোগসূত্র সম্পর্কে দেশটির অনলাইন প্রকাশনা দ্য প্রিন্ট জানাচ্ছে, তাঁর দাদু রামদাস সুনাক অবিভক্ত পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা থেকে ১৯৩৫ সালে কেনিয়ায় কেরানির চাকরি নিয়ে অভিবাসী হন। ঋষির অনুমোদিত জীবনীকার মাইকেল অ্যাশক্রফটকে উদ্ধৃত করে দ্য প্রিন্ট জানাচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকার কারণেই তাঁর এই দেশত্যাগ। তার আগেই অবশ্য রামদাস তাঁর স্ত্রী রানি সুনাককে নিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। গুজরানওয়ালার ক্ষত্রি বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পরিচয় না দেওয়ার কারণ হয়তো এটিই। রামদাস পরে কেনিয়ায় ব্রিটিশরাজের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েছিলেন। তাঁদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। তাঁদের একজন ঋষির বাবা ইয়াশভির সুনাকের জন্ম ১৯৪৯ সালে নাইরোবিতে। ইয়াশভির ১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে ডাক্তারি পড়তে আসেন এবং এখন সাদাম্পটনে বাস করেন।
ঋষির মায়ের পরিবারও পাঞ্জাবের এবং তাঁরাও আফ্রিকায় অভিবাসী হয়েছিলেন। তাঁর নানা রঘুবির বেরি রেলের প্রকৌশলী হিসেবে তাঞ্জানিয়ায় অভিবাসী হন। তিনি সেখানে জন্ম নেওয়া সরক্ষা সুনাককে বিয়ে করেন। জীবনীকার অ্যাশক্রফটের ভাষ্যমতে, সরক্ষা তাঁর গয়না বিক্রি করে ১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন এবং কিছুদিন পর তাঁর স্বামীও তাঁর অনুগামী হন। রঘুবির বেরি এরপর ব্রিটিশ রাজস্ব দপ্তরে চাকরি নেন এবং ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকার তাঁকে মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই) খেতাব দেয়। রঘুবিরের তিন কন্যার একজন উষা হলেন ঋষির মা। উষা অ্যাস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মাকোলজিতে ডিগ্রি নেন এবং তিনি একটি ফার্মেসি পরিচালনা করেন।
ডাক্তার পিতা ও ফার্মাসিস্ট মা ঋষির লেখাপড়ায় বিশেষভাবে নজর দেন এবং উচ্চ ব্যয়ের বেসরকারি আবাসিক স্কুল উইনচেস্টার কলেজে ছেলেকে ভর্তি করান। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ওই স্কুলে বার্ষিক ফি ৫০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা)। এরপর একইভাবে বেশ ব্যয়বহুল অক্সফোর্ড ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তাঁর উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হয়। অক্সফোর্ডে তিনি পড়েছেন দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি। ১৭২১ সাল থেক যুক্তরাজ্যে যতজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তার অর্ধেকের বেশি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন।
বাংলাদেশি কুটি মিয়ার রেস্তোরাঁর কর্মী ঋষি
ঋষির অক্সফোর্ডে পড়ার সময়টি বাংলাদেশিদের জন্য কিছুটা প্রাসঙ্গিক। ঋষি গ্রীষ্মকালীন অবকাশের সময়ে কাজের অভিজ্ঞতার জন্য সাদাম্পটনে একটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কারি হাউসে কাজ করেন। কুটি’স ব্রাসারি নামের রেস্তোরাঁটি বেশ জনপ্রিয় এবং এখনো তা চালু আছে। কুটি মিয়া রেস্তোরাঁটির মালিক। কারিবিষয়ক সাময়িকী কারি লাইফ–এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা জানান, কুটি’স ব্রাসারি তার বিভিন্ন খাবার ও সেবার জন্য রন্ধনশিল্পে বেশ কয়েকবার পুরস্কারও পেয়েছে।
ডিশি ঋষি
কারির সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে না হলেও ঋষি সুনাককে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডিশি (বাংলা উচ্চারণে দিশিও বলা চলে) ঋষি অভিহিত করে থাকে। এই অভিধা প্রথম চালু করে ডেইলি মেইল। কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের সময় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকারের তহবিল থেকে বেতন দেওয়ার এক নতুন নজির চালু করেছিলেন, যা ফারলো স্কিম নামে পরিচিত। এ ছাড়া রেস্তোরাঁ ও ফাস্ট ফুড ব্যবসাগুলোর সহায়তায় তিনি চালু করেন ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ প্রকল্প।
এ প্রকল্পে ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টে নাগরিকেরা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে মাথাপ্রতি ১০ পাউন্ড করে ছাড় পেয়েছেন, যে টাকাটা সরকার সরাসরি রেস্তোরাঁমালিককে দিয়েছে। হাউস অব কমন্সের ব্রিফিং পেপার বলছে, ওই প্রকল্পে রাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ৮৪ কোটি ৯০ লাখ পাউন্ড। সে সময়ে কোনো কোনো রেস্তোরাঁ দিশি মেনু নামেও আলাদা মেনুর কথা রেস্তোরাঁর বাইরে টাঙিয়ে রাখত। ওই প্রকল্পের কারণে রেস্তোরাঁগুলোতে জনসমাগম বেড়ে যাওয়ায় তা দ্বিতীয় দফায় কোভিড সংক্রমণের কারণ হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।