বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের অন্তরায় বা চ্যালেঞ্জ কোথায়?
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সম্প্রতি সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর গ্রেফতারের ঘটনায় দেশটিতে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকার কথা বলছে, কিন্তু হয়রানি, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা সহ নানা অভিযোগ করেন বিদেশি উদ্যোক্তাদের অনেকে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রোড শো করা হয়েছে।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা বলে বর্ণনা করেছেন।
এমন পটভূমিতে ঢাকায় বিনিয়োগ করে সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর বিপাকে পড়ার ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ঢাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বার্ষিক সভায় যোগ দিতে এসে গ্রেফতার হন কিছুদিন আগে। তারা ঢাকায় হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স নামের একটি কোম্পানির পরিচালক। বীমার টাকা না পাওয়ার অভিযোগে চারজন গ্রাহকের মামলায় তারা আটদিন কারাগারে থাকার পর জামিন পেয়েছেন।
তাদের আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, বিদেশ থেকে আসা এই বিনিয়োগকারীরা যাতে কোম্পানিটির মালিকানা ছেড়ে দেন, এমন পরিকল্পনা থেকে কোন পক্ষ মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঢাকায় আরেকটি বীমা কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বজলুর রশীদ।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী বজলুর রশিদ বলেন, বিশ্বাস করে আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করি। হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সে উনারা (সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী) অন্ধ বিশ্বাসে বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে আজকে গ্রেফতার করা হলো। এই ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয় আমাদের।
বিড়ম্বনা ও হয়রানির অভিযোগ
যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে বলা হচ্ছে। একইসাথে মামলা থাকার বিষয়কেও কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে এসে মালিকানার প্রশ্নে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
বছর চারেক আগে বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নারী উদ্যোক্তা মমতাজ খান। তাকে তার বিনিয়োগের শুরু থেকেই খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
সেই অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে মমতাজ খান বলেন, “আমি বাংলাদেশে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য সোশ্যাল হাউজিং প্রকল্প করতে গিয়েছিলাম”।
“কিন্তু বাংলাদেশে আমার কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আগে থেকে ছিল না। সেজন্য আমাকে থার্ড পার্টি বা অন্য একটা পক্ষ মানে বাংলাদেশি কোন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে প্রকল্পের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে, এটা কর্তৃপক্ষ জানালো। এটা জোগাড় করা অনেক কঠিন ব্যাপার।”
নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে বিনিয়োগ নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেছেন মমতাজ খান। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে প্রকল্পের মালিকানা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়েছে।
মিজ খান বলেন, “শেষ পর্যন্ত যখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জোগাড় করলাম। কিন্তু পরিস্থিতিটা আইডিয়াল ছিল না। সেজন্য আমি বাংলাদেশি ঐ পক্ষের কাছে আমার প্রকল্পটি দিয়ে চলে এসেছি।”
কোন বিদেশির ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন বাংলাদেশে কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কোন এজেন্টকে অংশীদার করে তার মাধ্যমে যেতে হয়।
একইভাবে বিদেশি বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশি পক্ষকে সাথে রাখতে হবে।
বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধাগুলো
দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বড় বাধা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
এটি বলা হয়েছে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে।
বাংলাদেশ সরকার বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দিচ্ছেন গবেষক ও বিশ্লেষকরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি সিনিয়র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, নানা বাধা পেরিয়ে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কম সংখ্যকই বিনিয়োগ করে থাকেন।
“আমাদের হিসাবে বাংলাদেশে যা নিবন্ধন হয়, তার এক তৃতীয়াংশও কার্যকরভাবে বিদেশি বিনিয়োগ হয় না।”
ড. ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন, “নিবন্ধনের সাথে বাস্তবায়নের এই যে পার্থক্য, এর মূল কারণ হলো, একটা কারখানা তৈরির জন্য যে সব সেবা প্রয়োজন, সেগুলো এক জায়গায় পাওয়ার ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়।
“কিন্তু বিনিয়োগকারীরা রসিকতা করে বলেন, এই ওয়ান স্টপ সার্ভিস অনেক সময় ফুল স্টপ সার্ভিস হয়ে যায়।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানিসহ যে সব সেবা পাওয়ার কথা, সেগুলো সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। বাংলাদেশে নিষ্কণ্টক জমি পাওয়াও বেশ কঠিন।
“এসবের ব্যাপারে সরকার থেকে একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা বলা হলেও এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তা চালু করা যায়নি। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক অঞ্চল দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু সেখানেও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া বড় ধরনের বিনিয়োগ এখনও হয়নি” গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সরকার যে একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে, এর একেকটি অঞ্চল একেকটি দেশের বিনিয়োগকারীদের দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তবে তাতেও বড় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের ডিজি আবুল হায়াত নুরুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার নানা সুবিধা কথা বললেও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের যারা বড় বিনিয়োগে আগ্রহী, তারাও নানা সমস্যার অভিযোগ করেন।