জুনের মধ্যে আসছে ১৫০ কোটি ডলার
ডলার–সংকট এখন আর লুকোচুরির বিষয় নয়। গত কয়েক মাসে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডলার বেশি চলে যাচ্ছে। আবার বিদেশ থেকে ডলার আসার অন্যতম উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়েও টান পড়েছে।
এ সংকট মোকাবিলায় সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীর কাছে বাজেট সহায়তার জন্য দ্বারস্থ হয়েছে। এসব সংস্থা ও দেশও বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তবে এ জন্য আর্থিক খাতের পাশাপাশি রাজস্ব খাতের সংস্কারের শর্ত আসতে পারে। সরকারি অর্থ খরচে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শর্ত থাকতে পারে।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, নিয়মিত সহযোগিতার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে এ চার দাতা সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশকে প্রায় দেড় শ কোটি ডলার দিচ্ছে। বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলমান সংকট মোকাবিলা করতে আগামী জুনের মধ্যে এডিবি ৫০ কোটি ডলার, আইএমএফ ৩৬ কোটি ডলার, জাপান ৩৫ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাংক ২৫ কোটি ডলার দিতে পারে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসের আগে অর্থ আসার সম্ভাবনা কম। এর বাইরে প্রকল্পভিত্তিক নিয়মিত সহায়তার অর্থ ছাড়ও হবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে রিজার্ভ প্রায় ৫০০ কোটি ডলার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গতকাল বুধবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৪০ কোটি ডলার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের ডলার দরকার। সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে সফল আলোচনা অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
এতে বিশ্বব্যাংকও প্রভাবিত হবে। সমস্যা হলো দর–কষাকষির আলোচনায় অনেক সময় চলে যায়। আমাদের দ্রুত ডলার দরকার। এখন বিদেশে টিউশন ফি পাঠাতেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন পর হয়তো চিকিৎসার জন্য ডলার পাওয়া যাবে না। এডিবি, জাইকাসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকেও দ্রুত অর্থ ছাড়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বাজেট সহায়তার বাইরে ২০২৫ সালের মধ্যে মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন সহায়তার অংশ হিসেবে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে।
বাজেট সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ দ্রুত ছাড় হলে দেশের আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে স্বস্তি বাড়বে।
দ্রুত এ ঋণের কিস্তি ছাড় হলে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অনেক বেশি পড়বে। তিনি আরও বলেন, এ অর্থ নিয়ে বসে থাকলে হবে না, সঠিক জায়গায় খরচ করলে ভালো হবে। ভুল পথে খরচ করলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। তাঁর মতে, গত কয়েক মাসের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেশ কমেছে। রিজার্ভ যাতে আরও খারাপের দিকে না যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য বিদেশি ঋণসহায়তাও প্রয়োজন।
ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের প্রথম কিস্তি
আইএমএফের সঙ্গে সাড়ে চার শ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। প্রাথমিকভাবে ওই অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে। তবে আর্থিক ও রাজস্ব খাতে কিছু সংস্কারের বিষয়ে শর্ত আসতে পারে। আগামী মাসে বোর্ড সভায় ওই ঋণ অনুমোদন পেলে ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ প্রথম কিস্তির ৩৫ কোটি ডলার দেশে আসতে পারে। সব মিলিয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি ডলার দেবে আইএমএফ। পরের কিস্তিগুলো প্রতি ছয় মাস অন্তত মিলবে।
আইএমএফের প্রতিনিধিদল মূলত পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া এবং ঝুঁকিতে থাকা গরিব মানুষের জন্য খরচ বাড়ানো; দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে মুদ্রানীতি আধুনিক করা; তৃতীয়ত, আর্থিক খাতে ঝুঁকি কমাতে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা; চতুর্থত, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সুশাসন ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করা এবং পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
আইএমএফের ঋণ অনুমোদন পেলে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়াও সহজ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিটের (ডিপিসি) আওতায় দ্বিতীয় কিস্তির ২৫ কোটি ডলার আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে পেতে পারে।
গত অর্থবছরে প্রথম কিস্তির ২৫ কোটি ডলার পেতে রপ্তানি খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত ছিল। তাই গত জুন মাসে বাজেট ঘোষণার সময় পোশাকসহ রপ্তানি খাতে কমিয়ে রাখা করহার বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়েও শর্ত আছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় কিস্তির জন্য নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুমোদন করতে হবে। আইনটি এখন অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া শুল্ক আইন, আয়কর আইন পাসের তাগিদও আছে।
এর বাইরে আরও ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। গত জুন মাসে এ নিয়ে বিশ্বব্যাংককে চিঠিও দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজারের সফরকালে ‘সবুজ প্রবৃদ্ধি’ কর্মসূচির আওতায় এ অর্থ পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।