যেসব শর্তে আইএমএফ’র ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ
অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রাথমিক সম্মতি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের বিষয়ে বুধবার বিকাল তিনটায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে দুপুরে আইএমএফ প্রতিনিধি দল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পরেই ঋণ পাওয়ার অগ্রগতি ও সার্বিক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আইএমএফ এই ঋণ দেবে সাত কিস্তিতে। শেষ কিস্তি বাংলাদেশ হাতে পাবে ২০২৬ সালে। সুদের হার হবে ২.২ শতাংশ। আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আইএমএফের ঋণ পেতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় শর্ত তারা দিয়েছে, সেগুলো আমরা নিজেরাই শুরু করছিলাম।
তিনি বলেন, ঋণের প্রথম কিস্তি আসবে ফেব্রুয়ারিতে, এর পরিমাণ হবে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। বাকি ঋণ প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর ৬৬০ মিলিয়ন এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) হিসাবে ৬টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে পাওয়া যাবে।
আইএমএফের ঢাকা সফররত প্রতিনিধি দল এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ দিতে বাংলাদেশ সরকার এবং আইএমএফ কর্মকর্তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন। এখন বাংলাদেশের ঋণের বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে আইএমএফের নির্বাহী পরিষদে পাঠানো হবে।
চলতি বছরের ২৪ জুলাই ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসেন।
মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারের অর্থবিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ বেশ কিছু সরকারি-বেরসকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ।
যখন কোন দেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে থাকে, তখন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের একটি দল সেদেশ পরিদর্শন ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে। সাধারণত এই সফরের সময় ঋণ প্রাপ্তির জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের বেশ কিছু শর্তও দেয়া হয়।
এসব শর্তের ব্যাপারে একমত হলে ঋণের ব্যাপারে প্রতিনিধি পর্যায়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর কথা বলা হয়। একে এখনো আইএমএফের পুরোপুরি সম্মতি বলা যায় না।
এই প্রতিনিধি দল ঋণের ব্যাপারে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর তার ভিত্তিতে আইএমএফের এক্সিকিউটিভ বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু কোন দেশের ঋণের ব্যাপারে প্রতিনিধি পর্যায়ে সমঝোতা হলে সেটি প্রত্যাখ্যানের নজীর নেই। বিবিসি
যেভাবে দেয়া হবে ঋণ
আইএমএফের পক্ষ থেকে পাঠানো একটি বিবৃতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ঋণ দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। বিয়াল্লিশ মাস বা সাড়ে তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এই ঋণ ছাড় করা হবে। অর্থাৎ পুরো ঋণটি পেতে ২০২৬ হয়ে যাবে।
এর মধ্যে এক্সটেনডেন্ড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ও এক্সটেনডেন্ড ফান্ড ফ্যাসিলিটির আওতায় ৩.২ বিলিয়ন আর রেজিলিয়ানন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটির ফ্যাসিলিটির আওতায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে।
এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের সমষ্টিক অর্থনৈতিক সুরক্ষা, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের চাপ সামলানো আর জলবায়ু সুরক্ষা তহবিলে সহায়তা করা।
আইএমএফ এর শর্তসমূহ:
০১. রাজস্ব বাড়ানো এবং যৌক্তিক ব্যয় ব্যবস্থা চালু করা। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। যারা নাজুক অবস্থায় থাকবে, সেসব খাত লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী নেয়া।
০২. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক মুদ্রানীতি তৈরি করা। সেই সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হার আরও নমনীয় করে তোলা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে আধুনিক মুদ্রানীতি।
০৩. আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা, নজরদারি বাড়ানো, সরকার ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা।
০৪. বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পরিবেশে তৈরি, মানব দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা।
০৫. জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, পরিবেশের উন্নতির পদক্ষেপ নেয়া এবং জলবায়ু সংক্রান্ত খাতে আরও বিনিয়োগ ও আর্থিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
আইএমএফ-এর এই সফর নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, যেমন রেভিনিউ বাড়ানো, সরকারও অনেকদিন ধরেই এসব নিয়ে কাজ করছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করার মতো শর্ত-এ নিয়ে আমরা অনেকগুলো মিটিং করেছি। তাদের শর্ত আমাদের শর্ত একই হলো।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাস, যন্ত্র ও পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। সেই চাপ সামলাতেই আইএমএফ দাতা সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
গত কয়েকমাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছরের তুলনায় অনেক নীচে নেমে এসেছে। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি অনেক বেড়েছে। ফলে দেশীয় বাজারে ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে।