পুতিনের দুনিয়া এখন আরও ছোট
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের সফল পাল্টা আক্রমণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে রুশ বাহিনী। এমনকি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ খেরসন থেকে নিজেদের সেনা সরিয়ে নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এসব কারণে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে রুশ সেনাদের ব্যর্থতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমালোচনা-কটাক্ষের মুখে পড়ছেন তিনি। সব মিলিয়ে রুশ নেতা পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রীতিমতো যেন একটা বাজি ধরলেন।
ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অতিরিক্ত ৩ লাখ সেনা নিযুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। পাশাপাশি এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে অব্যাহতভাবে সমর্থন জোগালে, অর্থ-অস্ত্র সহায়তা দিলে, প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে পিছপা হবেন না তিনি। এরই মধ্যে তিনি ইউক্রেনের রুশনিয়ন্ত্রিত চার অঞ্চলে গণভোট শেষে সেসব অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করতে ডিক্রিতে সই করেছেন।
এখন এই অঞ্চলগুলোতে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ হবে রাশিয়ার নিজ ভূখণ্ডে হামলার শামিল। এতে রাশিয়ার প্রতিশোধ গ্রহণের কৌশল জোরালো হবে। এসব কর্মকাণ্ড গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করা ও দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে সরানোর ক্ষেত্রে পুতিনের সিদ্ধান্তের ভুল হিসাব-নিকাশই তুলে ধরেছে। হামলা শুরুর ৯ মাস পরও পুতিন এ ভুল থেকে শিক্ষা নেননি; অথচ সেই ভুল প্রথমেই তাঁর জন্য বিপর্যয়-ধ্বংস ডেকে এনেছে।
পুতিনের চার ভুল
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পরপরই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রেসিডেন্ট পুতিন চারটি বড় ভুল হিসাব কষেছেন। প্রথমটি, রুশ সেনাবাহিনীর শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে অতিমূল্যায়ন। এতে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি যা শুনতে চাইবেন, তাঁর খুব কাছের মানুষগুলো তাঁকে শুধু তা-ই শোনাবেন। সে অনুযায়ী, পুতিনও দৃশ্যত বিশ্বাস করে নেন, ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনের ঝটিকা অভিযানেই সমাপ্তি ঘটবে ইউক্রেন যুদ্ধের; সেই সঙ্গে পতন ঘটবে কিয়েভের; এরপর জেলেনস্কি হয় আত্মসমর্পণ করবেন, নয় পালাবেন এবং তাঁর স্থলে রুশনিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল সরকার বসানো হবে। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই হয়নি।
সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, ইউক্রেনে অভিযানে যাওয়ার সময় রুশ সেনা কর্মকর্তারা সঙ্গে করে যুদ্ধে প্রত্যাশিত জয় উদ্যাপনে কুচকাওয়াজের আনুষ্ঠানিক পোশাক নিয়ে যান। কিন্তু রাশিয়ার সেনারা সেখানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের (এবং দৃশ্যত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর) ধারণার চেয়েও অনেক বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি; বরং তাঁদের অপমানজনকভাবে পিছু হটতে হয়েছে। পিছু হটার পথে তাঁরা রেখে এসেছেন ধ্বংসযজ্ঞ আর কিয়েভের উপকণ্ঠে বুচা শহর ও কাছাকাছি অন্যান্য এলাকায় নৃশংসতার চিহ্ন।
অনেক রুশ তরুণকে এই বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু লড়াইয়ের জন্য তাঁদের প্রস্তুতি ছিল সীমিত। ছিল না যথাযথ প্রশিক্ষণ। এমনকি এসব তরুণেরা জানতেনই না, ইউক্রেনে তাঁরা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন। রুশ সেনাদের মনোবল ও সাহসেও ছিল ঘাটতি। ট্যাংক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম মেরামত করার প্রয়োজন ছিল, সামরিক বাহিনীর রসদ ও সেনা সরবরাহব্যবস্থা ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও খাবারও সঙ্গে নিয়ে যাননি রুশ সেনারা। এ ছাড়া রুশ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি সামরিক বাহিনীতেও চিড় ধরিয়েছে। সেনাদের প্রশিক্ষণ ও সাজসরঞ্জাম বাবদ বরাদ্দ করা অর্থ গেছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে, এমন অভিযোগও ছিল।
হিসাবের দ্বিতীয় বড় ভুল, ইউক্রেনের জনগণ ও সেনাবাহিনীকে ছোট করে দেখা বা অবমূল্যায়ন করা। ইউক্রেনীয়দের জাতীয়তাবোধ ও লড়াইয়ের মনোভাব সম্পর্কে পুতিনকে সম্ভবত ভুল বোঝানো হয়েছে। পুতিন যদি এ আশা করে থাকেন যে, ইউক্রেনীয়রা তাঁদের রুশ ‘মুক্তিদাতাদের’ ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন, তবে তিনি এক বিরাট ভুল করেছেন।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার দখলদারি ও দনবাস অঞ্চলে অভিযান ইউক্রেনীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও বেগবান করেছে; যা পুতিন ধরতে পারেননি। এ বছর যখন রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরু করল, তখন জেলেনস্কিকে কিয়েভ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাঁর জবাব ছিল, ‘আমার উড়োজাহাজের দরকার নেই, আমার দরকার অস্ত্র।’
এ অবস্থায় দৃশ্যত রাশিয়া ইউক্রেনে মস্কোপন্থী সরকার গঠন করার জন্য কাউকে খুঁজে পায়নি। পরে এমন গুঞ্জনও শোনা যায়, ইউক্রেনে নিজেদের সহযোগীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পাওয়া রাশিয়ার প্রধান নিরাপত্তা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) উচ্চপর্যায়ে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আগে কমেডিয়ান ছিলেন। সেই পেশা ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করে একপর্যায়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হন। যুদ্ধ শুরুর আগে দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। তবে রুশ বাহিনীর হামলার পরও দেশ ছেড়ে না যাওয়া, যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে অদম্যভাবে নেতৃত্ব দেওয়া, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আগ্রাসনের শিকার একটি দেশ হিসেবে ইউক্রেনকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সফলতার জন্য দেশ-বিদেশে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। এমনকি অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভূমিকার সঙ্গে জেলেনস্কির অবস্থানের তুলনা করছেন।