কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
ফুটবলের সব পথ মিশে গেছে মরুর দেশ কাতারে। ক্ষণ গণনার দীর্ঘ পথও শেষ হওয়ার পথে। বছর, মাস এবং সপ্তাহের পর আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপরই বেজে উঠবে বিশ্বকাপের বাঁশি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো ফুটবল দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে রোমাঞ্চ যেমন আছে, তেমনি বিতর্কও কম নেই। যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার পর থেকেই।
একে তো বিশ্বকাপের সময় পরিবর্তন করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে করা হয়েছে, তার ওপর অনেকে অভিযোগ তুলছেন, কাতার ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের দৌড়ে এগিয়ে যায়। তাছাড়া কাতারের মানবাধিকার আইনগুলো নিয়েও বিতর্ক বহু পুরনো। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়, কাতারে বিশ্বকাপ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিক মারা গেছেন। এছাড়া নারীদের অধিকার ও সমকামীদের প্রতি দেশটির মনোভাব নিয়েও সমালোচনা আছে বিস্তর।
ঘুষ দিয়ে আয়োজক
বিশ্ব ফুটবলে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার পরই ২০২০ সালে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য জানায় সংস্থাটি। তাতে অভিযোগ করা হয়, ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পেয়েছে ধনী দেশ কাতার। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আয়োজক নির্ধারণে ফিফার নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সাবেক সদস্য ঘুষের প্রস্তাব পান। সেই প্রস্তাব তারা গ্রহণ করে কাতারের পক্ষে ভোট দেন। যদিও এমন অভিযোগ বরাবরই উড়িয়ে দিয়েছে কাতার।
এদিকে, নেদারল্যান্ডস ফুটবল দলের কোচ লুইস ফন গালও বলেছেন, শুধু আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপের মতো একটি বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে ফিফা। বিশ্বকাপের আয়োজক ইস্যুতে কারচুপির অভিযোগে নিষিদ্ধ হন সাবেক ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার। চলতি বছরের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের একটি আদালত তাকে অব্যাহতি দেন। সেই সঙ্গে অব্যাহতি পান তার সঙ্গে অভিযুক্ত মাইকেল প্লাতিনিও।
সেপ ব্লাটার ফিফার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের নাম ঠিক করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে ২২তম বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার অনুমতি পায় কাতার। সেই ব্লাটার সম্প্রতি বলেছেন, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নাকি ভুল ছিল। সুইস আউটলেট তেজেস অ্যানজেইগারকে ব্লাটার বলেন, ‘কাতারকে আয়োজক হিসেবে ঠিক করার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, ২০১৮ সালে রাশিয়া আর ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি পরাশক্তির দেশ। তারা পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করলে খুব ভালো হতো।’ কাতারের আয়োজক হওয়ার সিদ্ধান্তকে ঠিক কী কারণে ভুল বলছেন ব্লাটার? তার ভাষ্যমতে, ‘এটা (কাতার) খুব ছোট দেশ। ফুটবল আর বিশ্বকাপ সে হিসেবে অনেক বড় পরিসরের ব্যাপার-স্যাপার। আমার জন্য বিষয়টি পরিষ্কার, সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল।’
আলোর নিচে চাপা শ্রমিকের আর্তনাদ, ভুক্তভোগী বাংলাদেশও
কাতার বিশ্বকাপের ঝলমলে আলোর নিচে চাপা পড়ে আছে শত শ্রমিকের আর্তনাদ। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান দাবি করে বলেছে, বিশ্বকাপের বিভিন্ন প্রকল্পে গত এক দশকে প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক হাজার শ্রমিক। যার মধ্যে শুধু বাংলাদেশির সংখ্যাই এক হাজারের বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এক অতি-সমালোচিত লেবার পলিসি হলো কাফালা সিস্টেম। এ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক অভিবাসী শ্রমিকের একজন স্পন্সর থাকে, যিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই শ্রমিকের মনিব। একজন শ্রমিকের সব আইনি অধিকার ও ভিসার দায়িত্ব থাকে ওই কফিলের কাছে। যার ফলে শ্রমিককে ইচ্ছেমতো খাটানো অর্থাৎ অত্যাচার করা সহজ হয়ে যায়। কাতারে যেহেতু একজিট ভিসার ব্যবস্থা রয়েছে, আর তাই ভিসা কেড়ে নিলে কেউই স্বদেশে ফিরতে পারবেন না। তাছাড়া নানারকম আইনি প্যাঁচে ফেলে শ্রমিকদের তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও অনেক সহজ হয়ে যায়। মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে, নামমাত্র পারিশ্রমিকে চাহিদামতো কাজ করিয়ে নেয়ার এ এক অমানবিক প্রক্রিয়া।
তবে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কাতার কাফালা সিস্টেম কাগজে-কলমে তুলে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আদতে পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ নিয়ে বারবার অভিযোগ তুলেছে। কদিন আগে সংস্থাটি বিশ্বকাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কমপক্ষে ৪৪০ মিলিয়ন ডলার দিতে ফিফার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে গত এক যুগে কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর তদন্ত করতে কাতার কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি।
বিশ্বকাপের সময় পরিবর্তন
জুন-জুলাইয়ের পরিবর্তে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর শুরু হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। জুন-জুলাইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রচণ্ড গরমের কথা বিবেচনা করে দীর্ঘ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা। জুনে কখনো কখনো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়ার থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বিশ্বকাপের সময়ে পরিবর্তন এনে খেলোয়াড়দের ইনজুরির হার বাড়ছে। এছাড়া ক্লাব ফুটবলের ব্যস্ততা শেষেই সরাসরি কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে নেমে যেতে হচ্ছে ফুটবলারদের। আর তাই বিশ্বকাপ চলাকালেও ইনজুরির ঝুঁকি থাকছেই।
ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেক সাবেক তারকা ফুটবলাররা। তাদের একজন ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানির অধিনায়ক ফিলিপ লাম। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কাতারে না যাওয়ার কারণ জানিয়েছেন এই ফুটবলার। তিনি বলেন, একজন অফিশিয়াল প্রতিনিধি কিংবা একজন ভক্ত হিসেবেও আমি কাতারে যাচ্ছি না। যে দেশকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়, সেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত।
কাতারের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে যে গুটিকয়েক দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সমালোচনা করে, নেদারল্যান্ডস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (কেএনভিবি) তাদের মধ্যে একটি। কেএনভিবি কখনই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ছিল না এবং অবশ্যই যেভাবে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ করা হয়, তা অনুমোদন করে না। ডাচ কোচ লুইস ফন গাল বলেন, কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব দেয়ার বিষয়টিতেও জালিয়াতি করা হয়েছে। তার অভিযোগ, আমরা এমন এমন দেশে ফুটবল খেলতে যাই যেখানে ফিফা জানিয়ে রাখে ফুটবলের উন্নতিতে সহযোগিতা করতে তারা এই দেশটিকে বেছে নিয়েছে। পুরোটাই বাজে কথা ছাড়া আর কিছু না।
সমকামিতা ও নারীদের অধিকার
মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, যে কোনো মানুষ, তিনি যে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, যৌন পরিচয় বা জাতীয়তারই হোন না কেন, তাকে বিশ্বকাপে স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু তারা আবার একই সঙ্গে এটাও বলেছে যে, প্রকাশ্য স্থানে প্রেমের প্রকাশ ঘটানো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয় এবং স্থানীয় রীতি-নীতি মেনে চলতে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কাতার যেভাবে সমকামী নারী-পুরুষ, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অধিকার দমন করে, সেটি বারবার উঠে আসছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের যারা কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাবেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া নারীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান তো রয়েছেই।
মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল দেশটিতে যারা বিশ্বকাপ দেখতে যাচ্ছেন, তাদের বেশ কিছু কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যেমন অ্যালকোহল আমদানি অবৈধ হওয়ায় শুল্কমুক্ত মদ, সেক্স টয়, শুয়োরের মাংস এবং পর্নোগ্রাফির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কাতার। এই বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, এই নিয়ম না মানলে জেলে পর্যন্ত যেতে হতে পারে। লাগেজ স্ক্যান করার সময়ে যেকোনো ওষুধ পাওয়া গেলে সেটার জন্য অবশ্যই প্রেসক্রিপশন থাকতে হবে।
সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে এমনিতেই বিতর্ক তুঙ্গে। তার মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এক তথ্য সামনে এনেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম লা রাজন। তাদের দাবি, কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে সন্ত্রাসী হামলার ছক কষছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারীরা। টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলার এই পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে দাবি সংবাদমাধ্যমটির।
মরুর বুকে আগামী ২০ নভেম্বর ৩২ দেশের অংশগ্রহণে পর্দা উঠবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ ফুটবল বিশ্বকাপের। প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে এরই মধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হচ্ছেন সমর্থকরা। বলতে গেলে, মধ্যপ্রাচ্যের ছোট দেশটি বিশ্বকাপ উপলক্ষে মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠবে। আর তাই হামলার জন্য এটাই ‘সুবর্ণ সুযোগ’ বলে মনে করছেন আইএসের কিছু অনুসারী।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে, তাদের কাছে টেলিগ্রাম চ্যানেলে আইএস সমর্থকদের মেসেজের কিছু তথ্য রয়েছে। যেমন তারা লিখেছে, ‘সেখানে অনেক উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। কেননা সারা বিশ্বের বহু দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেবে। সেখানে বড় রকমের জমায়েত হবে। আমরাও একজন অংশগ্রহণকারী হওয়ার চেষ্টা করব। সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও কানাডা। এই তিন দেশকে তারা বড় লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। দেশগুলোর ফুটবলারই নয়, বরং সমর্থকদেরও টার্গেটে রেখেছে আইএস।
বিতর্ক ভুলে উপভোগের বার্তা ফিফার
মাঠের বাইরে বিতর্ক আর থামছে না। তবে সব ভুলে সবাইকে ফুটবলে মনোযোগ দেয়ার কথা বলছে ফিফা। তবে তাতে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চাইলেও পারছে না কাতার। কারণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। তাই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বিতর্ক সহজেই যে থামছে না, তা বলতেই হচ্ছে।