আদালত চত্বর থেকে যেভাবে জঙ্গি ছিনতাই
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে আট জঙ্গিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশের সদস্যরা।
তাঁরা যখন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আসেন, তখন হাতকড়া পরা দুই জঙ্গি তাঁদের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশের এক সদস্যকে মারধর শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশে থাকা জঙ্গিদের সহযোগীরাও পুলিশের ওপর হামলায় যোগ দেন। পুলিশের ওই সদস্যকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাঁদের ওপর হামলা এবং স্প্রে ছিটিয়ে সিজেএম আদালতের প্রধান ফটকের উল্টো দিকের গলি দিয়ে মোটরসাইকেলে করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেন সহযোগীরা।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার এমন বর্ণনা পাওয়া গেছে। পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া দুজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। তাঁরা আলোচিত জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই জঙ্গি সংগঠনের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। যার পরিকল্পনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও সমকামী অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়।
আদালত চত্বর থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় রোববার কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় ছিনিয়ে নেওয়ার সময় পুলিশ ধরে ফেলা ২ জঙ্গিসহ মোট ১০ আসামিকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিও এই মামলার আসামি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ২০১২ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন মেজর জিয়া। এই অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকায় দুই সেনা কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও পালিয়ে যান জিয়া। এরপর তিনি যুক্ত হন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে। বহিষ্কৃত জিয়ার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। আনসার আল ইসলামের বেশিরভাগ নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি। এরইমধ্যে কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রকাশ্যে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের আদালতে আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার আদালতগুলোতে প্রতিদিনই সাড়ে ছয় শ থেকে সাত শ আসামি হাজির করা হয়। পৃথক চারটি হাজতখানা থেকে আদালতগুলোতে আসামিদের হাজির করা এবং সেখান থেকে আবার হাজতখানায় নেওয়ার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন পুলিশের ১৯০ থেকে ২০০ জন সদস্য। প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যা কম। এর ফলে আদালতে আসামি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় ঘাটতি থেকে যায়। এ দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়েছেন জঙ্গিরা।
দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পর বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশজুড়ে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। তাঁদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, দুই জঙ্গিকে ধরতে ১০ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর সারা দেশে আদালত ও আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির তিনজনকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ (৩৫) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন।
অন্যজন জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান (৩৫) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। ওই বছরই সালাউদ্দিন ও জাহিদুলকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ সদর দপ্তর। জাহিদুল ২০১৮ সালে ভারতে ধরা পড়েছেন বলে সে দেশের গণমাধ্যমে খবর বের হয়।
দুই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়
ঘটনার সময় আদালতের ফটকের পাশে বসে থাকা একজন আইনজীবীর গাড়িচালক বলেন, হঠাৎ দুই আসামি পুলিশের এক সদস্যকে মারতে শুরু করেন।
আশপাশ থেকে মুহূর্তেই চার-পাঁচজন এসে হামলা শুরু করেন পুলিশের ওপর। তাঁরা পুলিশের ওই সদস্যকে সড়ক বিভাজকের ওপর ফেলে মারধর করেন। ঘটনা দেখে পুলিশের কয়েকজন সদস্য এগিয়ে গেলে তাঁদের ওপরও হামলা করা হয়।
যেখানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার পাশেই একটি ওষুধের দোকান। ওই দোকানের এক বিক্রয়কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুপুর ১২টার একটু পরে দেখি, আসামিদের হাতকড়ার সঙ্গে দড়ি ধরে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে কয়েকজন মিলে মারছেন। রাস্তায় পড়ে থাকা ওই পুলিশ সদস্যের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। পরে দেখি, পুলিশের হাত থেকে দুই আসামিকে নিয়ে কয়েকজন যুবক রঘুদাস লেনের দিকে পালিয়ে যান। এরপর দেখি কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাঁদের ধাওয়া করছেন।’
আহত পুলিশ সদস্য নূরে আজাদ রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আদালত পুলিশের হেফাজত থেকে পলায়ন
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) হেফাজতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আনা হয়েছিল। তবে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় আসামিরা ঢাকার আদালত পুলিশের হেফাজতে ছিলেন বলে জানিয়েছেন জিএমপি কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাশিমপুর কারাগার থেকে একজন উপপরিদর্শকের দায়িত্বে ১০ সদস্যের একটি দল কঠোর নিরাপত্তায় আসামিদের ঢাকায় আদালত পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আদালত পুলিশের হেফাজত থেকে আসামিরা পালিয়ে যান।
আদালত ও কারাগার সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আনসার আল ইসলামের সাত সদস্যকে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য তাঁদের আদালতে আনা হয়।
জঙ্গি মইনুল হাসানের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামে। অপরদিকে আবু ছিদ্দিকের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেটেশ্বর গ্রামে। তাঁদের ধরিয়ে দিতে পুলিশ একসময় পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। মইনুল হাসান ও আবু ছিদ্দিক একাধিক মামলার আসামি।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, দুটি মোটরসাইকেলে করে জঙ্গি ও তাঁদের সহযোগীরা পালিয়ে গেলেও তাঁদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে হাতকড়ার একটি চাবি উদ্ধার করা হয়েছে। ওই চাবি দিয়েই হাতকড়া খুলে পালিয়েছেন জঙ্গিরা। সূত্রটি আরও বলেন, জঙ্গিদের হাতে হাতকড়ার চাবি কীভাবে গেল, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।