ব্রিটেনে ড্রাইভিং টেস্ট বুকিংকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি সুসংগঠিত দালালচক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে বিবিসি। তদন্তে জানা গেছে, কিছু অসাধু ড্রাইভিং প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তাদের সরকারি লগইন তথ্য কিনে নিয়ে টেস্ট স্লট বাণিজ্য করছে টাউটরা, যার মাধ্যমে মাসে লাখো পাউন্ডের অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, একশ্রেণির দালাল মাসে সর্বোচ্চ ২৫০ পাউন্ড পর্যন্ত “কিকব্যাক” দিয়ে ড্রাইভিং অ্যান্ড ভেহিকল স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সির (DVSA) অনলাইন বিজনেস সার্ভিস (OBS)–এর প্রশিক্ষক লগইন তথ্য সংগ্রহ করছে। এসব লগইন ব্যবহার করে তারা বিপুল সংখ্যক ড্রাইভিং টেস্ট স্লট বুক করে, যা পরে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত দামে বিক্রি করা হয়—যেখানে সরকারি ফি সর্বোচ্চ ৭৫ পাউন্ড।
এই দালাল নেটওয়ার্ক লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার এবং হোম কাউন্টিসসহ বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়। বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা যায়, ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টরের পরিচয়ে যোগাযোগ করলে দালালরা মাসিক অর্থের বিনিময়ে OBS লগইন কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। একজন দালাল দাবি করেন, তিনি এক হাজারের বেশি প্রশিক্ষকের সঙ্গে কাজ করছেন। আরেকজন দালাল আনিল আহমেদ—‘আহাদিন’ নামে পরিচিত—বলেন, তিনি প্রতি সপ্তাহে নতুন করে দুজন প্রশিক্ষককে এই নেটওয়ার্কে যুক্ত করেন।
লগইন তথ্য পাওয়ার পর দালালরা শিক্ষার্থীদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের নামে টেস্ট বুক করে। পরে সেই স্লট তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এতে ডেটা সুরক্ষা আইনসহ DVSA–এর একাধিক নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। বিবিসির হাতে থাকা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, OBS সিস্টেমের স্ক্রিনশট এবং অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত প্রমাণ এই অবৈধ কার্যক্রমের বিস্তৃতি আরও স্পষ্ট করেছে।
এই দালালচক্রের কারণে বৈধ উপায়ে ড্রাইভিং টেস্ট বুক করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। DVSA–এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষে ব্রিটেনে ৬ লাখ ৪২ হাজার শিক্ষার্থী ড্রাইভিং টেস্টের অপেক্ষায় ছিলেন, যেখানে গড় অপেক্ষার সময় ২১ সপ্তাহ। অনেক এলাকায় এই অপেক্ষা ছয় মাস পর্যন্ত দীর্ঘ হচ্ছে। হতাশ হয়ে বহু শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর একজন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে টেস্ট বুক করেছেন।
ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কার্লি ব্রুকফিল্ড বলেন, “এটি ড্রাইভিং প্রশিক্ষক পেশার জন্য আত্মঘাতী। হাতে গোনা কিছু অসাধু ব্যক্তি পুরো শিল্পের সুনাম নষ্ট করছে।” তিনি জানান, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক প্রশিক্ষকের লাইসেন্স ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
বিবিসির অনুসন্ধানে লুটনে বসবাসকারী আনিল আহমেদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি চক্রের বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। ‘আহাদিন’ নাম ব্যবহার করে তিনি দাবি করেন, পরীক্ষার স্লট বিক্রির মাধ্যমে তার স্থায়ী আয়ের উৎস রয়েছে এবং তিনি ব্রিটেনের যেকোনো টেস্ট সেন্টারে স্লট জোগাড় করতে পারেন। তবে সরাসরি প্রশ্ন করা হলে তিনি নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। তবে ব্যাংক লেনদেন, ফোন নম্বর ও ঠিকানার তথ্য মিলিয়ে বিবিসি তার পরিচয় নিশ্চিত করেছে।
ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের আরেক দালাল খালিদ স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে OBS অ্যাকাউন্ট থেকে স্লট সংগ্রহ করার দাবি করেন। তিনি মাসে ২৫০ পাউন্ড পর্যন্ত প্রশিক্ষকদের দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং বলেন, তার রয়েছে “এক হাজার পার্টনার”। একই নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে হোম কাউন্টিতে সক্রিয় জামাল নামের আরেক দালালের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এই চক্রের বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই DVSA–র প্রধান লাভডে রাইডারকে লিখিতভাবে জানানো হলেও অভিযোগকারীদের দাবি, মূল হোতারা এখনও সক্রিয়। এক প্রশিক্ষক পিটার ব্রুকস বলেন, “বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। জামাল এখনও প্রকাশ্যে টেস্ট স্লট বিক্রি করছে—এটি অত্যন্ত হতাশাজনক।”
ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (FOI) অনুরোধের জবাবে DVSA জানিয়েছে, ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত নিয়মভঙ্গের অভিযোগে ৩৪৬টি OBS অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। পরিবহন বিভাগ (DfT) বলছে, আগামী বছরে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন নিয়ম—যেখানে শুধুমাত্র শিক্ষার্থী নিজেই টেস্ট বুক করতে পারবে—এই ধরনের অপব্যবহার কমাতে সহায়ক হবে।
তবে নতুন ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে দালালদের মাধ্যমেই ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়ার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সূত্র: বিবিসি