প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা সিলেট। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে বিদেশযাত্রা যেনো জীবনের একটি বড় স্বপ্ন, বিশেষত ইউরোপগামী তরুণদের চোখে-মুখে জ্বলজ্বল করে উন্নত জীবনের প্রত্যাশা। লন্ডন-ইউরোপের চাকরি, সচ্ছল জীবন, পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যৎ- সব মিলে এক মোহময় ভবিষ্যতের আশায় সিলেটের তরুণ সমাজ ঝুঁকেছে ইউরোপমুখী জীবনযাত্রার দিকে। আর ঠিক এই দুর্বলতাকেই পুঁজি করে সিলেটে ক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কিছু প্রতারক চক্র। যাদের নেই সরকারি অনুমোদন, নেই বৈধ লাইসেন্স-তবুও চটকদার বিজ্ঞাপন, ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট আর রঙিন প্রতিশ্রুতিতে তারা ফাঁদ পেতে বসে স্বপ্নবাজ তরুণদের জন্য। আর সেই ফাঁদেই ধীরে ধীরে আটকা পড়ে যায় অসংখ্য পরিবার, যাদের বিশ্বাস আর জীবনের সঞ্চয় ছিল একমাত্র পুঁজি।
জিন্দাবাজারের এলিগেন্ট মার্কেটের ১১ তলায় ‘এফএআই ইন্টারন্যাশনাল ইমিগ্রেশন অ্যান্ড এডমিশন কনসালটেন্সি ফার্ম’-এর অফিসে বসেই চালাতেন এই প্রতারণার রাজত্ব সিইও নাজিম উদ্দিন আদিল ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফারজানা শারমিন সোমা। নিজেদের পরিচয় দিতেন “ইউরোপে পাঠানোর বিশেষজ্ঞ” হিসেবে। দেখাতেন ভিসা অনুমোদনের ছবি-সব মিলিয়ে এক অভিনব, সুদৃশ্য সাজানো প্রতারণার নাটমঞ্চ।
এই ভুয়া বিশ্বাসকে পুঁজি করেই তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে তারা আদায় করতেন বিপুল টাকা-জনপ্রতি ১৫ থেকে ২৭ লাখ পর্যন্ত! কেউ বিদেশে ভালো চাকরির আশায় প্রস্তুত ছিলেন আইইএলটিএস দিয়ে, কেউ বেকারত্বের দুঃসময় পার করছিলেন, আবার কেউ পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় জমি-গহনা বিক্রি করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সবটুকু সঞ্চয়। শুরুতে দেখানো হতো নকল কাগজ, ‘এম্বেসি সাবমিশন’ লেখা ফাইল-যা ভুক্তভোগীরা বিশ্বাস করে ভেবেছিলেন, ইউরোপের দরজা যেন হাতের মুঠোয় এসে গেছে।
কিন্তু যত সময় গড়াত, ততই সত্যটা উন্মোচিত হতে শুরু করে। একের পর এক অজুহাত, সময়ক্ষেপণ আর বাড়তি টাকা চাওয়ার চাপ-সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে সন্দেহের বীজ রোপিত হয় ভুক্তভোগীদের মনে। আর একদিন হঠাৎ দেখলেন, সেই ঝলমলে অফিসের দরজায় তালা ঝুলছে। ফোন বন্ধ। স্বপ্ন এক মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার।
এভাবেই ‘স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্নহরণে’ দক্ষ হয়ে ওঠা এ দম্পতির প্রতারণার শিকার হন এলোমান আহমদসহ ডজন ডজন তরুণ।
অন্য এক ভুক্তভোগী জানান, আমি মালেশিয়ায় থাকাকালীন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। তারা সবকিছু করে আমাকে দেশে ফিরতে বলে। দেশে ফিরে বিভিন্ন অজুহাতে আমার কাছ থেকে মোট ৩১ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। ভিসা রিফিউজ হওয়ার পরই তারা সিলেট ছেড়ে লাপাত্তা হয়। চুক্তিপত্রে লেখা ছিল, ভিসা না হলে শুধু খরচ করা টাকা বাদ দিয়ে বাকিটা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু এখন তারা ফোনও ধরেন না, যোগাযোগও বন্ধ করে রেখেছেন। তাই আমরা তাদের খোঁজে মাঠে নামি এবং মামলা করি। আজ আমি মালেশিয়ার স্বপ্নময় জীবন ছেড়ে এসেছি, কিন্তু সব কষ্ট আর ঋণ এখন আমাদের পরিবারকে ভোগাচ্ছে। আমি যেসব মানুষ থেকে ঋণ নিয়েছিলাম, তারা এখন টাকা চাইতে এসে আমাদেরকে ধরছে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব ভুক্তভোগীদের কান্না একসময় গিয়ে ঠেকে কোতোয়ালী মডেল থানায়। ভোক্তভোগী মাছুম আহমদের দায়ের করা মামলাতেই প্রকাশ পায় ভয়ংকর চিত্র-ব্যাংক হিসাব, ক্যাশ রিসিট, মোবাইল ট্রান্সফার মিলিয়ে দম্পতি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ টাকারও বেশি! ভিসা না হলে ফেরত দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও তারা কারও পয়সা ফেরত দেননি।
অবশেষে দীর্ঘ তদন্তে পুলিশ জানতে পারে-এই দম্পতি সিলেট ছাড়িয়ে যশোরে আত্মগোপন করেছেন। শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে যশোর কোতোয়ালী থানার সেক্টর-৭ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। পরে রোববার সিলেটে এনে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
পুলিশ জানায়, অনেকদিন ধরেই সিলেটের স্বপ্নবাজ যুবসমাজকে টার্গেট করেই তারা প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন। আর বিদেশ-যাত্রার প্রবণতা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে প্রতারণার পরিমাণ-এ ঘটনাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবারগুলো।
ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাকড-ক্যাব) সিলেট জোনের সভাপতি ফেরদৌস আলম বলেন- কিছু প্রতিষ্ঠান যা খুশি করছে। আর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরো কনসালটেন্সি খাতটি। প্রতারকদের অবাস্তব প্রতিশ্রুতি, মিষ্টি কথা আর চকচকে বিজ্ঞাপন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তাদের জন্যই আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছি।