দেশে একদিকে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিয়ে চিকিৎসাসেবাকে ব্যয়বহুল করে তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে কোথাও কোথাও পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে চলছে ভয়ংকর প্রতারণা। ভুল পরীক্ষা ও পরীক্ষাবিহীন রিপোর্ট দেওয়ার এমন বহু অভিযোগ উঠেছে দেশের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার এক কিশোরী পেটব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষাটি করানোর পর রিপোর্টে জানানো হয়, স্কুলপড়ুয়া ওই কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। বিষয়টি পরিবারকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। সন্দেহ হওয়ায় পরে আরও দুটি হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হলে সেখানকার রিপোর্টে জানা যায়, কিশোরী গর্ভবতী নয়।
ঘটনার পর ক্ষুব্ধ স্বজনরা প্রথম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হামলা ও অবরোধ করেন। পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের তদন্তে উঠে আসে, ওই প্রতিষ্ঠানে আদৌ আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার মতো প্রশিক্ষিত জনবলই ছিল না।
এ ধরনের আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার মুখোমুখি হন রাজধানীর ধানমন্ডির একটি নামকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রক্ত পরীক্ষা করাতে যাওয়া এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। পরীক্ষার রিপোর্টে তাকে ‘গর্ভবতী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের ভুল স্বীকার করে নতুন করে পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিলেও ওই ব্যক্তি তাতে আর আগ্রহ দেখাননি।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে ভুল রোগ নির্ণয়ের ঘটনা এখনো নিয়মিত ঘটছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের রিপোর্টে নানা অসংগতি দেখা যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পুনরায় পরীক্ষা করাতে হয়। তাদের মতে, দেশে ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল এবং রোগ নির্ণয়ে কোনো মানসম্মত নীতিমালা কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। পর্যাপ্ত সরকারি তদারকির অভাব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দক্ষ প্যাথলজিস্টের পরিবর্তে অদক্ষ ল্যাব টেকনিশিয়ান কিংবা শিক্ষার্থীদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তৈরি করানো হয়। ফলে ভুল রোগ নির্ণয়ের শিকার হয়ে রোগী ও তার পরিবার শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার আগেই রিপোর্ট প্রস্তুত রাখা হয়। লোক দেখানো নমুনা সংগ্রহ করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোগীকে রিপোর্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগে চাঁদপুর শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। একই সঙ্গে পাশের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানেও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় সেগুলোকে জরিমানা করা হয়।
এর আগে চট্টগ্রামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু অভিযান হলেও সারা দেশে গড়ে ওঠা অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা খুব কমই নেওয়া হয়।
ফলে রোগ নির্ণয়ের নামে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। চিকিৎসাসেবার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে, আর কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান অবাধে সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে—এমন অভিযোগই এখন জনস্বাস্থ্য খাতের বড় বাস্তবতা।