লন্ডনের মেরিডিয়ান গ্র্যান্ডে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ব্রিটিশ বাংলাদেশি হুজ হু ২০২৫–এর ১৬তম প্রকাশনা উৎসব ও অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান। বাংলা মিরর গ্রুপের উদ্যোগে মঙ্গলবার আয়োজিত এই বার্ষিক গালা ডিনার ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট, কৃতী ও অনুকরণীয় ব্যক্তিদের সাফল্যকে তুলে ধরার এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এ বছরের অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তা ও মানবকল্যাণ ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রখ্যাত ব্রিটিশ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক আব্দুস সামাদকে।
পুরস্কারপ্রাপ্তির মুহূর্তে উপস্থিত দর্শক, কমিউনিটির বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকর্মী – সকলেই তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রভাবশালী ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্য, মানবিক কাজের গভীরতা, সমাজ উন্নয়নে অবদান এবং প্রযুক্তিকে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের দর্শন তাঁকে এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিজয়ীদের একজন করে তুলেছে।
আব্দুস সামাদের কর্মজীবন মূলত শুরু হয় প্রযুক্তি–নির্ভর ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। ২০০৫ সালে তিনি চালু করেন ক্যারিলন্ডন ডট সিও ডট ইউকে, (Curryলন্ডন.co.uk), যা যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক অনলাইন ফুড–টেক প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সময় ডিজিটাল ফুড ডেলিভারি ধারণাটি মূলধারায় পরিণত হয়নি, কিন্তু তাঁর উদ্যোগ ব্রিটিশ বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ শিল্প এবং গ্রাহকের মধ্যে আধুনিক সংযোগ গড়ে তোলে। এই প্ল্যাটফর্ম তাঁকে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশীয় উদ্যোক্তা সমাজে উদ্ভাবকের পরিচয় এনে দেয়।
পরবর্তী বছরগুলোতে তাঁর ব্যবসায়িক পরিধি বিস্তৃত হয় বীমা, হসপিটালিটি, রিয়েল–এস্টেট, প্রাইভেট হায়ার এবং প্রযুক্তিসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ভিন্টেজ এক্সসিডেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ (VAMG)–এর সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যেখানে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি উন্নত গ্রাহকসেবা, পেশাগত সততা এবং কমিউনিটির প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য খ্যাতি অর্জন করে।
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর প্রতিষ্ঠান মেডএক্স-ইউকে লিমিটেড করোনাভাইরাস মহামারির সময় অসংখ্য প্রাইভেট–হায়ার ড্রাইভারদের জীবন–জীবিকার সুরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা রাখে। লন্ডনজুড়ে আয়ের সংকটে পড়া ৮০–এর বেশি ড্রাইভারকে বিনামূল্যে গাড়ি প্রদান করে মেডএক্স-ইউকে উদাহরণ সৃষ্টি করে, যা ব্যবসার গণ্ডি পেরিয়ে মানবিক সহযোগিতার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
আব্দুস সামাদের ব্যবসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা আল-বারাকাহ ইনভেস্ট লিমিটেড, যার মাধ্যমে তিনি আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে সাশ্রয়ী আবাসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই নগরায়ণের উদ্যোগকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি ২০১৪ সালে লাভ২লন্ড্রি-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হন, যা বর্তমানে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও নেদারল্যান্ডসে সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
২০২৪ সালে চালু হওয়া তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প ফিউচারদেশ ব্যবসা–ভিত্তিক সামাজিক উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এই ফিনটেক প্ল্যাটফর্মে ৭০০–এর বেশি গ্রামীণ উদ্যোক্তা, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যুক্ত আছেন, যাদের সহায়তায় কাজ করছেন ১৩০ জন সামাজিকভাবে সচেতন বিনিয়োগকারী। শেয়ার্ড-প্রোফিট মডেলের মাধ্যমে \’ফিউচারদেশ\’ গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করছে। কৃষি, চাষাবাদ, উৎপাদন, টেক্সটাইল, খুচরা বিক্রয় – সব ক্ষেত্রেই এটি একটি বৃত্তাকার ও টেকসই গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা, যুবসমাজ ও ছোট কৃষকদের ক্ষমতায়নে ‘ফিউচারদেশ’ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক মডেলে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি আব্দুস সামাদ সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষাখাতে ধারাবাহিক উপকারের মাধ্যমে নিজেকে আলাদা মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর আব্দুস সামাদ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কালাম এন্ড সামাদ হাই স্কুল, এএফকে ট্রাস্ট ইসলামিক এডুকেশন সেন্টার এবং আনসারুন নেছা অরফানেজ –এ শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন, পুষ্টিকর খাদ্য, শিক্ষা ও উপকরণের যোগান নিশ্চিত করছে, যা শত শত শিশু–কিশোরীর জীবন বদলে দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে সমাজসেবা ও কমিউনিটি উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বেঙ্গলি ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশন – এর চেয়ারপারসন হিসেবে (২০১৪–২০১৯) তিনি বয়স্কদের যত্ন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শিশু ও তরুণদের প্রশিক্ষণ – এসব ক্ষেত্রে কার্যকর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। পাশাপাশি ওয়েস্ট ইউস্টোন প্রজেক্ট লিমিটেড – এর পরিচালক হিসেবে তিনি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, কমিউনিটি অংশগ্রহণ এবং সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্পে জড়িত ছিলেন।
ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি কমিউনিটির মানুষের পাশে থাকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে তিনি পরিচিত মুখ। ব্রিটেন সহ বাংলাদেশেও বহু মাত্রিক ব্যাবসা এবং মানুষের কল্যানে সেবামূলক কাজ করে আসছেন, নিজ জন্মভুমি সিলেটের গুলাপগঞ্জ লক্ষণাবন্দ এলাকায় তৈরী করেছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্টান যেমন স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদ। আয়োজকদের ভাষায়, তার কাজ তরুণ প্রজন্মকে সাহস দেয় এবং একধরনের ইতিবাচক শক্তি তৈরি করে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ – এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্য–বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, কমিউনিটি সংযোগ এবং সহমর্মিতার মেলবন্ধন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছেন। গ্রেনফেল টাওয়ার দুর্ঘটনা, কোভিড–১৯, গাজা, মরক্কো, পাকিস্তান ও সিরিয়ার মানবিক সংকট – এসব দুর্যোগে তিনি ফাউন্টেন অব মার্চি এবং ক্যাপ ফাউন্ডেশন–সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জ হু অনুষ্ঠানে আব্দুস সামাদের পরিবারের সদয়রা উপস্থিত ছিলেন, সে সময় তার দুই মেয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বাবার সাফল্যকে ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, বাবার প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এবং মানুষের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ। তারা জানান, ব্যস্ততার মাঝেও বাবার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষকে গুরুত্ব দেন এবং যে কোনও সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
এ বছরের ব্রিটিশ বাংলাদেশি হুজ হু অনুষ্ঠানে আরও যাঁরা সম্মাননা পেয়েছেন তারা হলেন: শাহেদ আহমেদ (হসপিটালিটি ও রিয়েল–এস্টেট ব্যবসা), ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কামরুল হাসান (আইন সেক্টর), ড. রিফাত এইচ মজুমদার (চিকিৎসা), মোহাম্মদ আফরুজ মিয়াহ বিইএম (চ্যারিটি ও কমিউনিটি), এমডি হারুন মিয়াহ (ফাইন্যান্স) এবং কাউন্সিলর নাদিয়া শাহ (রাজনীতি ও দাতব্য কাজ)। তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি অর্জন করেছেন এবং ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন।
কমিউনিটি ব্যাক্তিবর্গরা বলেন, আব্দুস সামাদের মতো উদ্যোক্তা এই প্রজন্মে খুব কম দেখা যায়। সামাদের জীবনকাহিনি নতুন ব্যবসায়ী এবং তরুণদের সামনে এক স্পষ্ট বার্তা দেয় যে সফলতা আসে সততা, ধারাবাহিকতা এবং মানুষের পাশে থাকার মানসিকতা থেকে।এই সম্মাননা কেবল সামাদের নয়, বরং পুরো কমিউনিটির গর্ব।
আব্দুস সামাদের এ সম্মাননা তাঁর ত্রিমাত্রিক পরিচয়ের স্বীকৃতি – তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা, একনিষ্ঠ সমাজসেবক এবং মানবতার পক্ষের জোরালো কণ্ঠস্বর। ব্যবসা, শিক্ষা, মানবিক সহায়তা ও প্রযুক্তিকে তিনি যেভাবে একই সুতোয় গেঁথে সমাজের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা তাঁকে ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির অনন্য ও অনুপ্রেরণাদায়ক নেতৃত্বে পরিণত করেছে।