সিলেটের সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোমের শাহী ঈদগাহ শাখার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আজমান আহমেদ দানিয়াল (১৯)-এর মৃত্যুকে ঘিরে শহরজুড়ে তৈরি হয়েছে আলোড়ন, উদ্বেগ ও ক্ষোভ। পরিবার, সহপাঠী ও বিভিন্ন মহলের মতে, এটি শুধুই আত্মহত্যা নয়—বরং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাপ, অপমান ও মানসিক অবহেলার শিকার হওয়া এক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক পরিণতি।
বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার বনকলাপাড়া এলাকায় নিজ বাসার ভেন্টিলেটরের সঙ্গে নাইলনের দড়ি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেন আজমান।
খবর পেয়ে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে।
আজমান আহমেদ দানিয়াল স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ শাখার ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি বনকলাপাড়ার নূরানী ৩৬/৯ নম্বর বাসার বাসিন্দা ও স্থানীয় ব্যবসায়ী রাশেদ আহমদের একমাত্র ছেলে।
সিলেট মহানগর পুলিশ এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এটি একটি আত্মহত্যার ঘটনা। ঘটনার সময় বাসায় কেউ ছিলেন না। তবে বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন, এবং ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজমানের বাবা জানান, প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়ায় কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল তাকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই-তিনদিন আগে কলেজে গিয়ে তারা এমন কথাই শুনেছেন।
তিনি বলেন, “শিক্ষকরা কোনো গালাগালি করেননি, কিন্তু ছেলেটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমি তাকে অন্য কলেজে ভর্তির চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই সে আত্মহত্যা করে।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, এই ঘটনায় প্রিন্সিপাল বা শিক্ষক কারও বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই, তবে পুলিশ বলেছে, তদন্ত চলছে।
আজমানের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই তার সহপাঠীরা এবং স্কলার্সহোমের সাবেক শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকের দাবি,
“স্কলার্সহোমে ছাত্রদের উপর পড়ালেখার চাপ, খারাপ ফলের কারণে মানসিকভাবে অপমান এবং ছাড়পত্র দিয়ে বের করে দেওয়ার সংস্কৃতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই।”
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সামাজিক মাধ্যমে বলেন,
“এটি আত্মহত্যা নয়, এটি একটি হত্যা। আজমান ফেল করেছে বলে তাকে সান্ত্বনা না দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দিতে চাওয়া কোনো মানবিক আচরণ নয়।”
আজমানের মৃত্যুর তিনদিন পর, ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার, স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ শাখার অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুনীর আহমেদ কাদেরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়, “আজমান আহমেদ দানিয়ালের আকস্মিক মৃত্যুতে স্কলার্সহোম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। তাই রোববার সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।” তবে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মনে করছেন, এটি একটি ‘বিক্ষোভ এড়াতে নেয়া প্রতিক্রিয়া’।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “মৃত্যুর তিনদিন পর হঠাৎ করে শোক বার্তা দিয়ে ক্লাস বন্ধ কেন? আমরা বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কর্তৃপক্ষ সেটা আঁচ করেই এমনটা করেছে।”
অধ্যক্ষ মুনীর আহমেদ কাদেরী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আজমানের বাবাকে ডেকে আমরা শুধু জানিয়েছিলাম, এভাবে চললে সে এইচএসসিতে পাস করতে পারবে না। চাইলে অন্য কলেজে নিতে পারেন। কোনো গালাগালি বা অপমান করা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কাউকে ছাড়পত্র দেই না। ফল খারাপ করলে অভিভাবকদের ডেকে জানানো হয়, যাতে তারা নজর দেন।”
পুলিশ জানিয়েছে, তারা তদন্ত অব্যাহত রেখেছে এবং কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তারা সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, “ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়াতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করতে।”