জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিরোধ কিছুটা প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিএনপি প্রকাশ্যে ভিন্নমত জানালেও সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। জামায়াত কিছু আপত্তি তুললেও নতুন কোনো কর্মসূচি দেয়নি, আর এনসিপিও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ফলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অনিশ্চয়তার যে মেঘ জমেছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তিন দলের ভারসাম্য–ই ভাষণের সফলতা
পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির স্বার্থ–দাবির একটি ভারসাম্য রাখা হয়েছে।
-
বিএনপি সন্তুষ্ট হয়েছে—নির্বাচনের দিনই গণভোটের ঘোষণা দিয়ে।
-
জামায়াত সন্তুষ্ট হয়েছে—পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং সনদবাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি ‘আদেশ’ আকারে দেওয়ায়।
-
এনসিপি স্বস্তি পেয়েছে—গণপরিষদের আদলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের দাবি পূরণ হওয়ায়।
এই তিন দলের বাইরেও গণসংহতি আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), জোট-ঐক্যের বিভিন্ন দল ও সংগঠন প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে “বাস্তবসম্মত” বলে মন্তব্য করে স্বাগত জানিয়েছে।
সংকটজর্জর ‘জুলাই সনদে’ অগ্রগতি
ঐকমত্য কমিশনের নয় মাসের আলোচনার ফসল ‘জুলাই সনদ’ গত ১৭ অক্টোবর ২৫টি দলের স্বাক্ষরে ঘোষণা হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক সংকট থেকেই গিয়েছিল।
গণভোটের তারিখ ও সনদের ব্যাখ্যা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ বড় দুটি রাজনৈতিক অবস্থানের টানাপোড়েন মাঠের আন্দোলনেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ—
-
নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা,
-
এবং সনদ বাস্তবায়নে গেজেট আকারে আদেশ জারি—
দলের মধ্যে সমঝোতা ফিরিয়ে এনেছে।
দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
বিএনপি জানায়, সনদ তারা মেনে চলবে। তবে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন কোনো ‘আরোপিত’ সিদ্ধান্ত তারা মানবে না।
জামায়াত বলেছে, সনদের সব সুপারিশ মানা না হলেও বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ accommodates করায় সরকারকে ধন্যবাদ। তবে গণভোটের প্রশ্ন বিভাজনকে তারা জটিল বলে মন্তব্য করেছে।
এনসিপি জানিয়েছে, সরকার সনদ নিয়ে পুরোপুরি দায়বদ্ধ হয়নি, কিন্তু সমাধানের একটি পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলন বলেছে—ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সব বাধা দূর হলো।
এবি পার্টি মন্তব্য করেছে—এটাই এখন ‘গ্রহণযোগ্য সমাধান’।
গণঅধিকার পরিষদ মনে করছে—সংশয় কাটলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি।
১২–দলীয় জোটের নেতারা বলেছেন—এখন আর নতুন দাবি নয়, সরাসরি নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নামতে হবে।
কারা লাভবান হলো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন—
তিন দলই প্রকাশ্যে কিছু বক্তব্য দিলেও বাস্তবে তারা সন্তুষ্ট। ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান জামায়াত।
বিএনপির মূল দাবি ছিল—নির্বাচনের আগেই গণভোট—যা বাস্তবসম্মত ছিল না।
জামায়াতের পিআরও এবং সংস্কার পরিষদের দাবি পূরণ হওয়ায় তাদের অর্জন বেশি।
এখন সামনে কী?
রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে—
-
নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত সর্বমোট সংকট অনেকটাই কমিয়েছে।
-
তবে সনদের দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
তবে আপাতত লক্ষ্য—আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীল রাজনীতি ও শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজন।