চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। আক্রান্ত রোগির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এই মাসের প্রথম ৯ দিনেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জন মারা গেছেন।
এদিকে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ১০টি সমন্বয়ক ও তদারক কমিটি। প্রতিটি কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৭ জন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা রয়েছেন। মশক নিধন অভিযান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সকল সিটি কর্পোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভায় কাজ করছে ৩ হাজার ২১৪ জন মশককর্মী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৮২২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১৯৬ জন এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৩৬ হাজার ১৫১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। এখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৫৭ জন এবং মারা গেছেন ১০৬ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এই সিটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৭ জন এবং মারা গেছেন ২৭ জন।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বাসস’কে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে একটি ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে সংখ্যা দেয়া হয় তা হাসপাতালের রোগি কেন্দ্রীক। দেশের সবচেয়ে বড় বড় হাসপাতালগুলোর অবস্থান ডিএসসিসিতে হওয়ায় এখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখানো হয়। এরপরও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম সঠিকভাবেই চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার কিন্তু একটি অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই সময়ে এমন বৃষ্টিপাত গত ৪/৫ বছরে দেখা যায়নি। এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এরপরও আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, যেটুকু এখন আছে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটা সম্পূর্ণ শূণ্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারবো।’
চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশক নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড়ভাবে তদারকি করতে ইতোমধ্যে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৪টি টিম এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৩টি টিম কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাজ পরিচালনার জন্য পৃথক একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা সংক্রান্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের এক জরুরি সভায় কমিটিগুলো গঠন করা হয়। এছাড়াও, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাব, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভার জন্য আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ডেঙ্গুরোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার কাজ সমন্বয় এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের টিম প্রধান করা হয়েছে। গঠিত টিমগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টি ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এলাকা পরিদর্শন এবং ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম মনিটরিং ও তদারকি করছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্য সংগ্রহ কমিটির কাছে নিয়মিতভাবে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় নেওয়া পদক্ষেপ এবং অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন দাখিল করছেন। এই কমিটি ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে জনসচেতনতা সৃষ্টি, মশার প্রজননস্থল বিনষ্ট, পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা এবং লার্ভা ও মশা নিধনসহ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৫ জন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৯ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩ জন। মার্চে আক্রান্ত ৩১১ জন, মৃত্যু হয়েছে ৫ জন। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ২ জন। মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ জন, মৃত্যু ৮ জনের। জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ২৬৯ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জন। আগস্টে আক্রান্ত ৬ হাজার ৫২১ জন, মৃত্যু হয়েছে ২৭ জন। সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ১৮ হাজার ৯৭ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮০ জন। বুধবার পর্যন্ত অক্টোবরের প্রথম ৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৮৮৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। এরমধ্যে বুধবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৩ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। মৃতদের মধ্যে ২ জন পুরুষ ও একজন নারী এবং ২ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং একজন উত্তর সিটির বাসিন্দা।
ঢাকা ছাড়াও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এখনই ডেঙ্গু রোগির উপচে পড়া ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর সেলিম উদ্দিন। তিনি জানান, গত ৫ দিন ধরে তিনি এই হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শুরুতে শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকলেও বর্তমানে কিছুটা উন্নতির দিকে। তিনি জানান, ‘তাদের এলাকায় দিনে রাতে সার্বক্ষণিক মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মানুষ। মশক নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোন ওষুধ ছিটানো হয় না।’
রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা মিজানুর রহমান বাসস’কে জানান, রাতে যেমন-তেমন মশার কামড়ে দিনের বেলায়ও টেকা দায়। মাঝে মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোসহ ফগিং করতে দেখা যায়। নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হলে মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসিরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতো বলে তিনি বলেন।
ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগির চাপ সামলাতে সাধারণ ওয়ার্ডের বাইরেও আলাদা করে সিঁড়ির কাছে, বারান্দায় রোগিদের জন্য বেডের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এ হাসপাতালে পূর্ণবয়স্ক রোগিদের একটি ফ্লোরে, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা ফ্লোরে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউসহ অন্যান্য হাসপাতালে। হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগির স্বজনদের।
মুগদা হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. সত্যজিত সাহা বাসস’কে বলেছেন, প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ৩ থেকে ৪শ’ রোগি চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে। গতমাসের তুলনায় এই মাসে ক্রমাগত রোগির সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি জানান, এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসাদের মধ্যে সব বয়সের রোগিই রয়েছে। পূর্ণবয়স্ক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি বেশি হলেও মোট রোগির ৩০ শতাংশ শিশু।