ইরানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক ব্রিটিশ নাগরিক লিন্ডসে ফোরম্যান ও তার স্বামী ক্রেগ ফোরম্যানের পরিবার জানিয়েছে, তারা প্রায় এক মাস ধরে দম্পতির অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। এমনকি গত দুই সপ্তাহ তারা নিশ্চিত ছিল না—লিন্ডসে ও ক্রেগ ইসরায়েলি বোমা হামলায় মারা গেছেন কিনা।
২৩ জুন তেহরানের berখ্যাত এভিন কারাগারে একটি ইসরায়েলি বোমা হামলায় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। ফোরম্যান দম্পতির অবস্থান নিয়ে তখন থেকে পরিবার চরম উৎকণ্ঠায় ছিল। তাদের ধারণা ছিল, দম্পতিকে আগেই কেরভান শহর থেকে তেহরানে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু অবশেষে জানানো হয়েছে, তারা এখনো দক্ষিণ ইরানের কেরভানে আটক রয়েছেন।
৫২ বছর বয়সী লিন্ডসে ও ক্রেগ গত জানুয়ারিতে মোটরসাইকেলে আর্মেনিয়া থেকে পাকিস্তান হয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে কেরভান শহরে গ্রেপ্তার হন। ইরান তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনেছে। দম্পতি নয় বছর ধরে বিবাহিত এবং সম্প্রতি স্পেনে বসবাস করছিলেন।
লিন্ডসের ৩১ বছর বয়সী ছেলে, জো বেনেট বলেন, “প্রতিদিন অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে। রাতে ঘুমোতে গেলেও ভয়, সকালে উঠেও সেই একই প্রশ্ন—তারা কেমন আছে? কোনো যত্ন নেওয়া হচ্ছে কি? মানসিকভাবে তারা কতটা ভেঙে পড়েছে?”
তিনি মনে করেন, ফোরম্যান দম্পতির সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হচ্ছে তাদের পরিচিতি ও উপস্থিতি মানুষের জানা থাকা। তিনি বলেন, “আমরা চুপ থাকলে, তারা আরও ঝুঁকিতে পড়ে। সচেতনতা জীবন বাঁচাতে পারে।”
বেনেট বলেন, “আমরা চাই ব্রিটিশ সরকার তাদের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নিক। কেয়ার স্টারমার (যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী) যদি ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তাহলে যেন লিন্ডসে ও ক্রেগের নাম উঠে আসে। ওরা যেন আলোচনার টেবিলের আড়ালে হারিয়ে না যায়।”
ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত তিনবার তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রথমবার দেখা যায়, ক্রেগের ওজন অনেক কমে গেছে এবং তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ মাত্র ৯ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল, হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। তৃতীয় সাক্ষাতে তারা একসঙ্গে থাকতে পেরেছেন, কারাগারের দোকানে যাওয়ার অনুমতিও পেয়েছিলেন।
তারা একটি ছোট ঘরে থাকেন, যেখানে একটি ধাতব খাট ও পাতলা গদি রয়েছে। দিনে মাত্র ১৫ মিনিট উঠোনে হাঁটার সুযোগ পান। কোনো ব্যায়াম করতে চাইলে তারা জায়গার ঘাটতির কারণে আট আকারে ঘুরে ঘুরে পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ানোর চেষ্টা করেন।
সম্প্রতি তাদের একজন আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছেন, তবে তিনি ইংরেজি না জানায় যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে। এতে বিচার প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি খুব ধীরে হচ্ছে।
বেনেট তার মাকে কিছু ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে। একটি বার্তায় তিনি লিখেছেন, “আমি রাতে চাঁদের দিকে তাকাই, যদি মা-ও তাকান, তাহলে আমরা সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই।” এই ছোট ছোট ইঙ্গিতেই তিনি আশার আলো খোঁজেন।
ইরানে ছয় বছর বন্দি থাকা ব্রিটিশ নাগরিক নাজানিন জাঘারি-র্যাটক্লিফ বলেন, “সেলে বিছানা ছিল না, কেবল একটি পাতলা কম্বল। আলো সবসময় জ্বলে থাকত, ঘর ঠান্ডা আর আতঙ্কে ভরা ছিল।”
জো বেনেট বলেন, “আমার মা ও ক্রেগ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না, তারা অপরাধীও নয়। তারা দুজন সাধারণ মানুষ, একজন মা, একজন বাবা, একজন বোন ও ভাই। তারা ভ্রমণ ভালোবাসে, মানুষকে ভালোবাসে, নতুনের সঙ্গে সংযোগ ভালোবাসে।”
ইরানে ভ্রমণের ব্যাপারে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা সেখানে গেলেন—এই প্রশ্নের জবাবে বেনেট বলেন, “তারা ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল। এই ঘটনা তাদের জীবনে প্রথম নয়, শুধু ‘যুক্তরাজ্যের নাগরিক’ হওয়াই যেন তাদের অপরাধ।”
তিনি বলেন, “ইরান একে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে, যেমনটি তারা ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও করেছে।”
এই কঠিন সময়ে বেনেটকে পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের দেখাশোনাও করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমার মা ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানে আগ্রহী, আর ক্রেগ খুবই বাস্তববাদী। তারা একে অপরের সঙ্গেই আছেন, এটুকুই সান্ত্বনা। তবে আমরা জানি না, তারা এখন কেমন আছে। ভয়, দুশ্চিন্তা—সবকিছু এখনও রয়ে গেছে।”
তিনি শেষ কথা বলেন, “তাদের নাম যতবার উচ্চারিত হবে, ততবার তারা বুঝবে—তারা ভুলে যাননি।”