এক সময় যার বেহালার সুরে বিমোহিত হতো জনসমাগম, আজ তিনি নিজেই নিঃশব্দ—শয্যাশায়ী এক বাউল, যিনি নিজের জীবনকেও যেন রচনা করেছেন এক করুণ সুরে। বলছি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার দামোধরতপী গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা, বাউল বশির উদ্দিন সরকারের কথা।
বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের সরাসরি শিষ্য এবং প্রখ্যাত বাউল কফিল উদ্দিন সরকারের কাছে দীক্ষা নেওয়া এই গুণী শিল্পী সম্প্রতি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জীবনযুদ্ধে পরাজিতপ্রায়। চলাফেরা করতে পারেন না, কথা বলেন ধীরে, কিন্তু তাঁর চোখে জমা থাকে হাজারো কথা। চিকিৎসা চলছে না অর্থাভাবে—এ যেন এক সঙ্গীতপ্রেমিক জাতির জন্যই লজ্জার বিষয়।
এক সময় গ্রামীণ মঞ্চ মাতানো এই শিল্পীর গলায় ছিল মানবতার বাণী, প্রেম ও সত্যের জয়গান। লোকজ সংগীতকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি যেমন গেয়েছেন, তেমনি গড়েছেন নতুন পথ। তাঁর বেহালা আর তবলা আজ পড়ে আছে ঘরের এক কোণে, নিঃসঙ্গ, ব্যবহৃত না হয়ে ধুলোয় ঢাকা—যেন প্রতিফলন বাউলের নিজ জীবনেরই।
এই দুঃসময়ে বাউলের পাশে আছেন তাঁর সহধর্মিণী, যিনি সার্বক্ষণিক শুশ্রূষা করে চলেছেন। কিন্তু অর্থাভাব তাঁকেও করেছে অসহায়। চোখের কোণে জমা জলই যেন তার নিত্যসঙ্গী। বাউল বশির বলেন, “আমার জীবনে সম্পদ বলতে কিছুই নেই, আছে শুধু আমার চারটি বই।” এই বইগুলোতে রয়েছে তাঁর লেখা গান, তাঁর দর্শন, এবং লোকসংগীতের প্রতি তাঁর নিরলস সাধনার ইতিহাস।
লোকগানের এই সুরসাধকের সহশিল্পীরা চাচ্ছেন, তাঁর এই সৃষ্টি যেন হারিয়ে না যায়। তাঁরা দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন—বাউল বশিরের পাশে দাঁড়ানোর, যেন তিনি কিছুদিন হলেও সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন।
সহশিল্পী লাল শাহ্ বলেন, “এই মানুষটা শুধু গান করেননি, মানুষ গড়েছেন। তাঁকে হারানো মানে এক বড় সম্পদ হারানো।”
বাউল আনোয়ার বলেন, “বাউল বশিরকে সাহায্য করা মানে বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা।”
গুণী এই শিল্পীর কঠিন সময়ে আপনি-আমিও হতে পারি তাঁর পাশে। আমাদের ক্ষুদ্র সহায়তা, আন্তরিক ভালোবাসা আর সামাজিক সহানুভূতি হয়তো তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারে জীবনের সুর। আর সুর বাঁচলে, বাঁচে আমাদের সংস্কৃতি—আমাদের আত্মপরিচয়।