আজ থেকে শুরু হচ্ছে ২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। দেশের অন্যান্য শিক্ষাবোর্ডের তুলনায় সিলেট শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডের অধীনে অংশ নিচ্ছেন ৬৯ হাজার ৯৩১ জন শিক্ষার্থী, যা গত বছরের তুলনায় ১৩ হাজার ২৩৪ জন কম।
২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ১৬৫ জন। মাত্র এক বছরে শিক্ষার্থী সংখ্যা হ্রাসের এই বিপুল চিত্রটি কেবল একটি সংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি সিলেটের সমাজে প্রবাসমুখী তরুণ প্রজন্মের এক গভীর বাস্তবতা ও পরিবর্তনের প্রতিফলন।
সিলেট দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অন্যতম প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সিলেটিদের উপস্থিতি সুদৃঢ়। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কেউ যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য, আবার কেউ শ্রমিক ভিসা নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই নয়, এখন অনেকেই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই পরিবারের সঙ্গে বা এককভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা বাড়ছে। গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে এই চিত্র আরও বেশি প্রকট।
সিলেটের একাধিক কলেজের শিক্ষক জানিয়েছেন, প্রতি বছর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা পরিবারের সঙ্গে বা এককভাবে বিদেশে চলে গেছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিয়ে ইংরেজি ভাষার কোর্সে ভর্তি হচ্ছে, মূল লক্ষ্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি।
সিলেটের একটি কলেজের প্রভাষক ফয়েজ আহমদ বলেন, “বছরের শুরুতে যারা ভর্তি হয়, তাদের অনেকেই বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশে চলে যায়। কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীকে দেখা যায় কোচিংয়ের পরিবর্তে আইইলটিএস বা ভাষা শেখার কোর্সে ভর্তি হতে। এতে শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে, যা ব্যক্তি ও জাতির জন্য ক্ষতির কারণ।”
অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর মধ্যেই এখন উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহের চেয়ে বেশি রয়েছে বিদেশযাত্রার তাড়না। কিন্তু এই যাত্রা অধিকাংশ সময়েই হয় অপ্রস্তুত ও ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষতা, ভাষাজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব থাকায় তারা বিদেশে গিয়ে মানবেতর অবস্থায় পড়ছে। কোনো একটি নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পরিবর্তে তারা হয়ে পড়ছে ঝুঁকির মুখে থাকা কর্মজীবী।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে পড়াশোনা বা কর্মসংস্থানের প্রবণতা বাড়ছে। অনেকেই কলেজে ভর্তি না হওয়ায় এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। এটি আমাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। অভিভাবক, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যে হারে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে, তা শুধু শিক্ষাক্ষেত্র নয়, সমাজ ও অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাসের এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, সিলেটের শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। তরুণরা যখন শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখেই বিদেশের স্বপ্নে বিভোর হয়, তখন তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য একটি দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এখনই যদি অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকরা সচেতন না হন, তবে ভবিষ্যতে এর পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ।