তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ও গণমাধ্যমের পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা।
বই, জার্নাল, পত্রিকা থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট টিভি—তথ্য আহরণের মাধ্যমে এক সময় মূলধারার গণমাধ্যম কর্তৃত্বের শীর্ষে থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (Facebook, YouTube, Twitter) উত্থানের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এই প্ল্যাটফর্মে গড়ে ওঠা ব্যক্তিনির্ভর বিশ্লেষণী কন্টেন্ট ও মতামতভিত্তিক ভিডিওর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রেই মূলধারার গণমাধ্যমকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে কিছু কণ্ঠ।
বিশেষ করে শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিকভাবে সীমিত হয়ে পড়ায়, মানুষ বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের। তারা শুধু তথ্য-নির্ভর বিশ্লেষণ নয়, বরং সরাসরি জনমত গঠনে এবং আন্দোলনমুখী বার্তা প্রচারে বড় ভূমিকা রাখছেন।
প্রভাবশালী কয়েকজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
পিনাকী ভট্টাচার্য
সাবেক বামপন্থী, লেখক ও বিশ্লেষক পিনাকী বর্তমানে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর থেকে তিনি সরকারের নজরে থাকেন। ফেসবুক ও ইউটিউবে তার অনুসারী প্রায় অর্ধ কোটি। শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনায় তার কণ্ঠ অন্যতম বলিষ্ঠ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রসঙ্গে তার বক্তব্যগুলো বিতর্ক তৈরি করেছে।
ইলিয়াস হোসেন
সাবেক টেলিভিশন উপস্থাপক ও সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে তার প্রচারিত নানা ভিডিও কনটেন্ট এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনে তিনি অনলাইন রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছেন। নুসরাত হত্যাকাণ্ড, বনজ কুমার ও মেজর ডালিমের সাক্ষাৎকার নিয়ে তার কন্টেন্টগুলো আলোচনায় এসেছে।
জুলকারনাইন সায়ের খান (সামি)
আল জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সামি সেনাপ্রধানের ঘনিষ্ঠ মহলের তথ্য নিয়ে কাজ করেন। আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে তার দেওয়া তথ্য মাঠপর্যায়ে আশ্বাস হিসেবে কাজ করেছে।
তাসনিম খলিল
নেত্র নিউজ-এর প্রতিষ্ঠাতা তাসনিম খলিল গুম, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার। তার ও সামির যৌথভাবে প্রকাশিত ‘আয়নাঘর’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেশে ও বিদেশে প্রচুর আলোড়ন তোলে।
অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ও বিতর্ক
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে ঘিরে পিনাকী ও ইলিয়াসের সমালোচনার জবাবে সামি তাকে সমর্থন করেন। এছাড়া ইলিয়াস হোসেনের একটি ডকুমেন্টারিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ভারতের দালাল হিসেবে চিত্রিত করার ঘটনায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিএনপির মির্জা আব্বাসসহ আরও কয়েকজন রাজনীতিক তাদের বিদেশ থেকে সমালোচনাকে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিয়েছেন।
বিকল্প ন্যারেটিভের উত্থান
এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা অনেক ক্ষেত্রেই সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে নতুন বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। তারা সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে জনমত গঠন, বিশ্লেষণ এবং আন্দোলনে প্রেরণা জোগানোর মাধ্যমে গণমাধ্যম ও রাজনীতির বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গেলেও, একথা অনস্বীকার্য যে তারা এক নতুন ধরনের নাগরিক রাজনীতির প্রতিনিধি। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশে এই শ্রেণির কণ্ঠস্বর ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে—যদি তা গঠনমূলক, তথ্যনির্ভর ও জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয়।