জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বলেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে দমনমূলক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে দিয়ে দেশের নাগরিক সমাজের সংগঠন, বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, আইনজীবী এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা ব্যক্তিদের দমন-পীড়ন করেছে।
চলতি মাসের শুরুতে জেনেভায় প্রকাশিত ওএইচসিএইচআর-এর ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সোচ্চার নাগরিক সমাজকে দমন করতে বিচার ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে।’
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রমবর্ধমানভাবে দমনমূলক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে নাগরিক সমাজের সংগঠন, বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, আইনজীবী এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা ব্যক্তিদের ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি, মিথ্যা মামলা এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্বিচারে গ্রেফতার, জোরপূর্বক গুম ও হত্যা করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ আইন সরকারি কর্মকর্তাদের এনজিও এবং তাদের সদস্যদের কার্যক্রম তদন্ত, পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ‘বিরোধী মত দমন করতে এনজিওর নিবন্ধন বাতিল, বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ এবং প্রকল্প অনুমোদনে গড়িমসি করেছে’।
এর ফলে সরকারের সমালোচক বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
ওএইচসিএইচআর বলেছে, বিদেশি অনুদান আইন, ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ১৯২৩ সালের সরকারি গোপনীয়তা আইন, দণ্ডবিধির মানহানি সংক্রান্ত ধারা, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরবর্তী কালে ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনে ‘অপরাধ সংক্রান্ত ব্যাপক ও অস্পষ্ট ধারা’ রয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এই আইনগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ভীতি প্রদর্শন ও চুপ করানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।’ এছাড়াও, এই আইনগুলোতে গ্রেফতার, তল্লাশি, জব্দ ও নজরদারির ‘অত্যধিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা যথেষ্ট বিচারিক তদারকি ছাড়াই প্রয়োগ করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ এবং সিসি ক্যামেরা নজরদারি কাঠামো গড়ে তুলেছিল। ‘এই নজরদারি ব্যবস্থা ব্যবহার করে বেসামরিক ও রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করে গ্রেফতার ও জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে’।
জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এই নজরদারি কাঠামোর কেন্দ্রে রয়েছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, এনটিএমসি ইসরাইলি এবং অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক নজরদারি সরঞ্জাম ও সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেছে। এনটিএমসি এর কাঠামোর সঙ্গে পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই, র্যাব এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী সংযুক্ত করে তাদের নজরদারি তথ্যে ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যাক্সেস দিয়েছে।
ওএইচসিএইচআর রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের অস্পষ্ট ধারার ভিত্তিতে ব্যাপক নজরদারির ক্ষমতা সংরক্ষণের দাবিদার এনটিএমসি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে ডিজিটাল নজরদারি নিয়ন্ত্রণ করেনি।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে দমনমূলক আইনগুলো বাতিল বা সংশোধনের পরামর্শ দিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইন, সরকারি গোপনীয়তা আইন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও দণ্ডবিধির মানহানি সংক্রান্ত ধারার অধীনে গ্রেফতার, তদন্ত বা মামলা স্থগিত করার সুপারিশ করেছে।
রিপোর্টে এই আইনগুলোতে গ্রেফতার, তল্লাশি, জব্দ ও নজরদারির অত্যধিক ক্ষমতা সীমিত করার এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের পাশাপাশি এই ক্ষমতাগুলোর ওপর যথাযথ বিচারিক তদারকি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
ওএইচসিএইচআর বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, ন্যায্য, নিরপেক্ষ এবং ব্যাপক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়াও, ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের আগের মামলাগুলো এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার মামলাগুলোও তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম, গ্রেফতার, তল্লাশি, জব্দ ও নজরদারি ব্যবস্থার ওপর প্রকৃত তদারকির জন্য বিচার বিভাগকে প্রয়োজনীয় তহবিল ও কর্মী সরবরাহের পাশাপাশি সরকার বা রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।