রংপুর অঞ্চলে কোন ভাবেই কমছে না তামাকের আগ্রাসন। সরকারের নানা উদ্যোগেও এই বিষপাতা উৎপাদন থেকে ফেরানো যাচ্ছে না কৃষকদের। সিগারেট কোম্পানিগুলোর নানা ধরনের প্রণোদনার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তামাক চাষ করছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। গত বছর থেকে এ বছর উৎপাদন বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, উৎপাদনের আগে কোম্পানির তামাকের দর নির্ধারণ, বিক্রয়ের নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, পরামর্শ দানসহ সাত কারণে অন্যান্য ফসল ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা।
রংপুর সদর উপজেলার খাপরিখাল এলাকার কৃষক রজব আলী গত বছর চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলেন। তার খরচ হয়েছিল ৮৬ হাজার টাকা। ওই জমিতে উৎপাদিত ৩৩ মণ তামাক বিক্রি করেছেন ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায়। বাড়তি লাভের আশায় এবার সাত বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন তিনি।
রজব আলী বলেন, ‘এ বছর তামাকের দাম আরও বাড়বে। কোম্পানির লোকজন এসে তামাক কিনে নিয়ে যায়। তামাকের বাজারদর নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। এ বছর তামাক দিয়ে মাঠ ভরে গেছে।’
একই উপজেলার মমিনপুর এলাকার কৃষক রাসেল মিয়া বলেন, ‘তিনি গত ৩৯ বছর ধরে তামাক চাষ করছেন। তবে এ বছরের মতো ব্যাপক জমিতে তামাক চাষ আগে কখনো দেখেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর অনেক কৃষক নতুনভাবে তামাক চাষ করেছেন। তামাক কোম্পানি থেকেই বীজ, সার, কীটনাশক ও সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হয়। গেল বছর তামাকের বাজারদর বেশি ছিল। তাই এ বছর কৃষকরা তামাক চাষে আরও বেশি ঝুঁকেছেন।’
রংপুর নগরীর হাজিরহাট এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘৪ বিঘা জমি আলু চাষের জন্য প্রস্তুত করেন তিনি। কিন্তু বীজের দাম, সার সংকটসহ এবার আলুর দাম নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা ভেবে তিনি তামাক চাষ করতে বাধ্য হয়েছেন।
রংপুরের অভিরাম এলাকার কৃষক দম্পতি আকবর আলী ও হাসিনা বেগম জানান, গেল ১০ বছর ধরে টানা তামাক চাষ করেছেন তারা। এই সময়টাতে তামাকের বিকল্প নানা ফসল রয়েছে। তবে তামাকে কখনই লোকসান হয় না, চাহিদাও ভালো। সেকারণেই বাদ দিচ্ছেন না তামাক চাষ।
দীর্ঘ মেয়াদে তামাক চাষে যুক্ত থাকায় এই অঞ্চলের কৃষকরা স্কিন ডিজিস, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট’ এর গবেষণা বলছে, তামাকজনিত ব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তামাক এবং বিড়ি, সিগারেটের ধোয়ায় ৭ হাজারের বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যার মধ্যে ৭০ টি সরাসরি ক্যানসারে আক্রান্তে প্রভাব ফেলে। গ্যাটস এর প্রতিবেদন বলছে, দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাক জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. তাপস বোস জানান, তামাকের বহুল ব্যবহার হৃদ্রোগ, ক্যানসার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক অপ্রতিরোধযোগ্য রোগ ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, গেল ১০ বছরে রংপুর অঞ্চলে তামাক উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী। চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে তামাক চাষ হয়েছে ১৯ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে, অথচ আগের মৌসুমে ছিল ১৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টর।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তামাকে বেশি লাভের আশায় কৃষকরা এই ফসল চাষে ঝুঁকছে। তবে এই বিষপাতা চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক, সচেতনতা সভা করা হচ্ছে।’
গবেষকদের মতে, শস্য বিন্যাস ,উৎপাদন এবং বিপণনে কৃষকদের সহায়তার পাশাপাশি তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের গুরুত্ব দিতে হবে সব থেকে বেশি।