বিশ রামাদান, ২০২৫ সালের ২১ মার্চ, রোজ শুক্রবার। দিনটার যেন মন খারাপ, কালো মেঘে ছেঁয়ে আছে পুরো আকাশ। না রোদ না গরম মেঘলা ও শীতল। বাদ জুমআ আমি মদিনা মার্কেট কিছু খরচ করে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় প্রবেশ করতেই দাদা ভাই, কবি মহসিন কবির ইমন কল দিয়ে বলছেন আমির কোন খবর জানো? একটু ভয়েই বললাম না! কি হইছে? দাদা ভাই জানালো জাহিদ এক্সিডেন্ট করছে? তাড়াতাড়ি ফোন রেখে জাহিদের নাম্বারে কল দিলাম। রিং হওয়া সত্ত্বেও কেউ ফোনটা রিসিভ করছে না। একাধিক চেষ্টা করেও ফোনে পাইনি। পরে মাছুম এবং মাহবুবকে কল দিয়ে নিশ্চিত হই এক্সিডেন্টের বিষয়টি। এর কিচ্ছুক্ষণ পরেই ফেসবুকের নিউজ ফিডজুড়ে জাহিদের মৃত্যুর সংবাদ। জাহিদ মারা গেছে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমি যাদের নিউজ ফিডে প্রথমেই পেয়েছি সাথে সাথে ইনবক্সে নক করে জানতে চাইলাম, নিহত ব্যক্তির নাম পরিচয় ঠিকানা? জানতে পারলাম আমাদের জাহিদেই আর কেউ নয়! মুহূর্তেই যেন নির্বাক হয়ে পড়লাম। মানুষ ইতেকাফের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আল্লাহ তাআলার গৃহে জীবনের গুনাহ ক্ষমার আশায়। কিন্তু জাহিদ বুঝি স্বয়ং আল্লাহর কাছে ইতেকাফে বসার জন্য চলে গেলো অনন্ত জীবনের পথে! অসম্ভব কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে বলতে হচ্ছে বড় সৌভাগ্যবান মানুষ প্রিয় জাহিদ, রোজা রেখে, জানাজা পড়ে, অজু অবস্থায় পবিত্র রামাদান মাসে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিনে শুক্রবারে আল্লাহর সান্নিধ্যে সবাই যেতে পারে না, কপাল লাগে ভাগ্য লাগেরে ভাই?
পরে জানলাম সিলেট থেকে দুলাভাইয়ের চিকিৎসা শেষে বাইকে করে বাড়ি ফিরছিল। দিরাই একটি জানাজা পড়ে বাসটেন্ড থেকে পাথারিয়া পথে দিরাই ফায়ার সার্ভিসের সামনে আসতেই সিলেট থেকে দিরাইগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের সাথে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়। তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এক জানাজা পড়ে শেষ করতে না করতেই বাড়ি ফিরার আগেই নিজেই এখন জানাজার লাশ! আহ মানুষের জীবন কত সংক্ষিপ্ত কত অনিশ্চিত ভাবতেও ভয় লাগে, কষ্ট লাগে।
রফিনগর ইউনিয়নের কৃতি সন্তান, তরুণ আলেম ও শিক্ষক মাওলানা তৌফিকুর রহমান জাহিদ। আমার বোন জামাইদের মধ্যে সে তৃতীয় এবং সবার ছোট। প্রিয় ছোটবোন মায়মুনা আক্তার রলি’র প্রিয়তম স্বামী। ২০২২ সালে জামিয়া দারুল কুরআন সিলেট থেকে কৃতিত্বের সাথে তাকমিল ফিল হাদীস সমাপ্ত করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কর্মজীবনের শুরুতেই রওশন আরা চৌধুরী দারুসসুন্নাহ মাদরাসায় শিক্ষকা করে। তিন বছরের সংসারজীবনে তাঁর ফুটফুটে এগারো মাস বয়সি একটি অবুঝ কন্যা সন্তান রয়েছে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে বাংলাবাজার একটি নতুন ব্যবসার উদ্বোধন করে মাত্র শুরু করেছিল। কিন্তু সেই ব্যবসা শুধু স্বপ্ন আর উদ্বোধন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো।
তৌফিকুর রহমান জাহিদের সাথে আমার ব্যক্তিগত সব স্মৃতিই সুন্দর, স্বাভাবিক। যতটুকু জানি, মনে পড়ে জাহিদ আমার ফুফাত ভাই নুরপুরের আমির হোসাইনের ক্লাসমীট। রুলির সাথে বিয়ের পর আমার সাথে একদিন দিরাই বাজারে দেখা হয়েছিল। ওই দিন তাঁর মোটরসাইকেলে করে দিরাই থেকে পাথারিয়া হয়ে বাংলাবাজার ফিরছিলাম। এর বাইরে আমার সাথে বাজারে দেখা হত সালাম বিনিময় হত। আমার পক্ষ থেকে আদর আপ্যায়নের প্রস্তাব থাকত। আমার আক্বদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল আমার সাথে আমার শ্বশুড়বাড়িতে দাওয়াতে ছিল। আজ সবই যেন অতীত দিনের স্মৃতির ঝাঁপি!
মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেবের জ্যোষ্ঠপুত্র, মাওলানা তৌফিকুর রহমান ১৬ মার্চ ২০০০ সালে দিরাই উপজেলার অন্তর্গত রফিনগর ইউনিয়নের কান্দাহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই এক ভদ্র নম্র ও শান্ত সুশৃঙ্খল বালকের নাম তৌফিকুর রহমান জাহিদ। আদব- আখলাক, ইলম ও আমলে জাহিদ ছিল সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। চেহারা ছুরতে ছিল অত্যন্ত রুচিশীল ও মার্জিত। ব্যক্তিজীবনে জাহিদ বড় মায়ার মানুষ ছিল আমার। তাঁর মায়াময় মুখ আজ কেবলই স্মৃতি। দেখা হলেই সালাম দিয়ে ভাই ভালা আছো? একটুরো হাসি উপহার দিত। অনেক মায়া মমতা তাঁর পাওনা রেখেই হঠাৎ চলে গেলো। এই বিদায় কত যে বেদনাবিধুর, অসহ্য কষ্টের, কি করে বুঝাই?
প্রিয় বোনটি আজ আমার অসহায় ও নিঃস্ব। সান্ত্বনা দেওয়ার মত কোন ভাষা নেই মুখে। তবুও নিয়তির এই নির্মম বাস্তবতা মেনে নিতে হবে মালিকের ইচ্ছায়। আল্লাহ তাআলা জাহিদের কর্মময় জীবনের সকল ভুল-বিচ্যুতি ক্ষমা করে প্রিয় ভাইকে জান্নাতের উচ্চ মাকামে সমাদৃত করুন। জান্নাতে ইফতারের সু-ব্যবস্থা করুন, আল রাইয়্যানের গেইটে ফেরেশতাদের সংবর্ধনায় ধন্য করুন। প্রিয় বোনটিকে মহান মালিক আমেনার মত ভাগ্যবতী ও ধৈর্যশীলা করুন। আমাদের সবাইকে সবরে জামিল দান করুন।