যুক্তরাজ্যের চাকরির বাজারে নেমে এসেছে বড় ধরনের ধস। মাত্র এক মাসে দেশটিতে বেতনভিত্তিক চাকরি হারিয়েছে ৭৮ হাজারের বেশি মানুষ। এটি করোনার পর সবচেয়ে বড় চাকরি হারানোর ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে ভয় বাড়ছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে, যাদের অনেকেই হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দোকান, কেয়ারহোম, টেইলারিং বা ডেলিভারি কাজের সঙ্গে যুক্ত।
যুক্তরাজ্যের সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তর (Office for জাতীয় Statistics – ONS) জানিয়েছে, মার্চ মাসে যেসব মানুষ নিয়মিত পে-রোলে বা বেতন সিস্টেমে ছিলেন, তাদের মধ্যে ৭৮ হাজার লোকের চাকরি চলে গেছে। ফেব্রুয়ারিতেও প্রায় ৮ হাজার চাকরি হারিয়েছিল। এটি স্পষ্ট করছে, দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে এবং কোম্পানিগুলো খরচ কমাতে গিয়ে চাকরি ছাঁটাই শুরু করেছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বেতন কিছুটা বেড়েছে—গত তিন মাসে গড় বেতন বেড়েছে প্রায় ৫.৯ শতাংশ। তবে একই সময়ে কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি কর এবং ন্যাশনাল লিভিং ওয়েজ বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়ে গেছে অনেক। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান কম মজুরি দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেয়, যেমন হসপিটালিটি, হেয়ারড্রেসিং, দোকানপাট—তারা সবচেয়ে বেশি চাপে আছে।
এই চাপ সামলাতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কম কর্মী রাখছে বা কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দিচ্ছে।
ব্রিটেনে বসবাসরত হাজার হাজার বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরে রেস্টুরেন্ট, কেবাব শপ, কেয়ারহোম, হেয়ার সেলুন কিংবা গার্মেন্টস খাতে কাজ করে জীবিকা চালিয়ে আসছেন। এখন সেই সব চাকরিও ঝুঁকির মধ্যে।
পূর্ব লন্ডনের একটি রেস্টুরেন্টে কর্মকর্তা বলেন-“আগে সপ্তাহে ৫-৬ দিন কাজ করতাম। এখন মালিক বলছে, সপ্তাহে ৩ দিন কাজ দিতে পারবে। ভাড়া, খাবার ও পরিবার—সব মিলিয়ে কষ্টে আছি।”
আরেকজন বাংলাদেশি নারী কর্মী, যিনি কেয়ার হোমে কাজ করতেন, তিনি জানালেন—“আমার কন্ট্রাক্ট বাতিল করে দিয়েছে। নতুন চাকরি খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। এ অবস্থায় অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর বাড়ানো এবং ন্যাশনাল লিভিং ওয়েজ ৬.৭% বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে চাকরি হারাচ্ছে সাধারণ কর্মীরা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে হসপিটালিটি ও খুচরা ব্যবসার ওপর, যেখানে অনেক বাংলাদেশি কর্মরত।
একটি হেয়ারড্রেসিং সেলুনের মালিক বলেন— “স্টাফদের বেতন দিতে গিয়ে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গেলে কাউকে না কাউকে বিদায় জানাতে হচ্ছে।”
চাকরির সংখ্যা কমার পাশাপাশি নতুন নিয়োগের হারও কমেছে। মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় ২৬ হাজার চাকরির বিজ্ঞাপন কমে গেছে। ফলে নতুন কাজ খোঁজার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন চাকরি পাওয়া আগের মতো সহজ নয়। নিয়োগদাতারা নতুন লোক নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠেছে।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ যুদ্ধ, এবং ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ কর বৃদ্ধির ফলে দেশের বাজারে চাহিদা কমছে। ব্যবসাগুলো বিনিয়োগ কমাচ্ছে, খরচ বাঁচাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে।
অর্থনীতিবিদ সঞ্জয় রাজা বলছেন—“আমরা এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে বাজারে অস্থিরতা বেশি। কোম্পানিগুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে সাহস পাচ্ছে না।”
চাকরি হারানো কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি অনেক বাংলাদেশি প্রবাসীর জন্য ভিসা জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেকেই কাজের ভিত্তিতে ভিসায় আছেন। চাকরি না থাকলে তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে যায়।
একজন প্রবাসী বলেন— “আমার ভিসা শেষ হতে চলেছে। নতুন চাকরি না পেলে ভিসা নবায়ন করাও কঠিন হয়ে যাবে। আমি খুব চিন্তায় আছি।”ব্রিটেনের বর্তমান চাকরির বাজার শুধু স্থানীয় নাগরিকদের নয়, বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবনেও বড় প্রভাব ফেলছে। কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, আয় হ্রাস এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা প্রবাসীদের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। সরকার এবং কমিউনিটি লিডারদের উচিত এখনই উদ্যোগ নেওয়া—চাকরি খোঁজা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং আইনি সহায়তায় প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানো।