অনুগ্রহপ্রাপ্তির এই মাসে মুমিনের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করা উচিত। এমাসেই জীবনের পাপমোচন করার উত্তম সুযোগ। আল্লাহ তায়ালা ও রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ পালন করে জীবনের আমুল পরিবর্তন আনা উচিত এমাসে-ই।
আল্লাহ তায়ালা ও রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ পালন আমার সকলের জন্য-ই আবশ্যক। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ও রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিষয় পালন করতে বলেছেন সেগুলো পালন করা আর যেগুলো থেকে বিরত থাকতে বলেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুমিনের জন্য আবশ্যক।
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসুলের আনুগত্য কর, আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো বিনষ্ট করো না। (সুরা: মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৩) আয়াতে মহান আল্লাহ ও নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ পালন করতে বলা হয়েছে।
হাদিসে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছি তোমরা সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকো। আর যেসব বিষয় পালন করতে বলি, সেগুলো সাধ্যনুযায়ী পালন করো। কারণ, তোমাদের পূর্ববর্তীরা তাদের অধিক প্রশ্ন ও তাদের নবীদের সঙ্গে মতভেদ করার ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে। ( মুসলিম, হাদিস:১৩৩৭; বুখারি, হাদিস: ৭২৮৮)
তবে সকল বিধান-এর মধ্যে কিছু বিধান এমন রয়েছে, যেগুলো পালন করা একজন মুমিনের জন্য অতীব জরুরি। যেমন: নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। আবার কিছু বিধান এমন রয়েছে যেগুলো থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। আজকে এমন কিছু বিষয়ে কথা বলবো,–যেগুলা থেকে একজন মুমিনের জন্য বেঁচে থাকাটা খুবই জরুরি। মহিমান্বিত এ মাসে নিন্দনীয় এ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার অভ্যাস করে নিতে হবে। নিন্দনীয় এ বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
শিরক। শিরক থেকে বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় গুনাহ শিরক করা, এটি আল্লাহ তায়ালার কাছে সহনীয় নয়। কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই শিরক মহাপাপ। (সুরা:লুকমান,আয়াত:১৩) শিরক এর মর্মার্থ হলো–কাউকে আল্লাহ তায়ালা-এর সমকক্ষ মনে করা।
চাই সেটা আল্লাহ তায়ালা-এর সত্তার সাথে হোক। যেমন একথায় বিশ্বাসী হওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন ইলাহ তথা প্রতিপালক রয়েছেন। অথবা গুণাবলীর সাথে। যেমন–কাউকে জীবনদাতা,মৃত্যুদাতা সাব্যস্ত করা ইত্যাদি। শিরক গুনাহকে আল্লাহ তায়ালা কখনো ক্ষমা করেন না। কোরআনে বলা হয়েছে,“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শিরক গুনাহ ক্ষমা করেন না; তবে অন্য সকল প্রকারের গুনাহ আল্লাহর যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করেন।( সুরা: নিসা,আয়াত: ৪৮)
আরেকটি ভয়ঙ্কর নিন্দনীয় বিষয় হচ্ছে, কাউকে জিনার অপবাদ দেয়া। এটি খুবই জঘন্য গুনাহ। এই মিথ্যা অপবাদ সমাজ গঠনে অনৈক্যের ভুমিকা রাখে। মানুষের অধিকার,মান-সম্মান ক্ষুন্ন করে। এটি বান্দার হকের সাথেও সম্পৃক্ত। বান্দা ক্ষমা না করলে কিয়ামতের দিনে শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না অপবাদদাতা।কোরআনে জিনার অপবাদদাতার বিরুদ্ধে দুনিয়া ও আখিরাতে ভীতিপ্রদ শাস্তির কথা ঘোষণা হয়েছে। দুনিয়ার কী শাস্তি- এ নিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা সতী- কোন মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলো; অথচ চারজন সাক্ষীর মাধ্যমে তা প্রমাণিত করতে পারেনি, তাহলে তোমরা তাদেরকে ৮০ টি করে বেত্রাঘাত করো, কারও ব্যাপারে তাদের সাক্ষ্য আর কখনো গ্রহণ করো না এবং তারাই তো প্রকৃতপক্ষে গুনাহগার।” (সুরা: নুর,আয়াত :৪)
আখেরাতেও অপবাদদাতা শাস্তির আওতাভুক্ত হবে। ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই যারা সতী অবলা, মুমিন নারীদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত ও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। (সুরা: নুর,আয়াত :২৩)
অন্যায়ভাবে কাউকে খুন করা। এটিও বড় গুনাহের মাঝে অন্যতম। অন্যায়ভাবে খুন করার অর্থ হলো–হত্যার অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করে ফেলা। তবে এক্ষেত্রে শরিয়ত বলেছে,যাকে হত্যা করা হবে তার পরিবার হত্যাকারী থেকে কেসাস তথা হুবহু প্রতিশোধ নিতে পারবে। অন্যায়ভাবে হত্যাকে কোরআন সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে (কখনো) কাউকে হত্যা করো না। ( সুরা: ইসরা,আয়াত: ৩৩)
বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া। জন্মলগ্ন থেকেই তারা সন্তানকে দেখভাল করে এসেছেন। শিশুকাল থেকে কৈশোর,যৌবনকালে পদার্পণ করিয়েছেন মা-বাবা। সুতরাং কষ্ট দেওয়া তাদের প্রতি অবিচারের শামিল। তাদের কষ্ট দেওয়া সন্তানের জন্য দূর্ভাগ্যের বিষয়। এটিও খুবই বড় প্রকারের গুনাহ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সাথে সৎব্যবহার করবে।
পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে-ই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। (সুরা: ইসরা, আয়াত: ২৩)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। এটি হাদিসের ভাষায় বড় গুনাহ। এটি ভোটাভোটি-এর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতে পারে। নির্বাচনে এমন ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ যিনি ইসলামি বিধানে অযোগ্য। মিথ্যা সাক্ষ্য হাদিসের ভাষা অনুযায়ী নিষিদ্ধ ও হারাম। রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে জানান দেবো না? তিনবার একথা বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা, মাতা-পিতার নাফরমানি করা, তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর উঠে বসলেন এবং বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। কথাটি তিনি বার বার বলছিলেন। এমনকি আমরা বললাম, যদি তিনি চুপ হয়ে যেতেন। (মুসলিম, হাদিস: ৮৭)
সুদ ভক্ষণ করা। সুদ সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। মানুষের অধিকার হরণ করে। সুদের পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ। এক হাদিসে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্বংসাত্মক সাতটি গুনাহের কথা বলছেন এবং সুদ খাওয়াকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সুদ ভক্ষণ কোরআনের ভাষায় অবৈধ। ঘোষণা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বেচাকেনা-কে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সুরা: বাকারা, আয়াত:২৭৫)
গিবত করা। গিবত এর মর্ম হলো–কারও নিকটে অপরজনের দোষত্রুটি বর্ণনা করা। এটি সমাজের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে। দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি করে। সমাজের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। শরিয়তে এটি নিষিদ্ধ। কোরআনে গিবত-এর নিন্দা করে বলা হয়েছে, “তোমরা একে অপরের যেন গিবত না কর। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ পছন্দ করে? অনন্তর তোমরা তা অপছন্দ কর। (সুরা:হুজুরাত, আয়াত: ১২)
মদ বা নেশা জাতীয় কোনকিছু ভক্ষণ করা। এটি মানবীয় মেধার কার্যকরিতা নষ্ট করে ফেলে। আকলের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়াও মদ খাওয়ার উপকার থেকে অপকারই অনেক।
জুয়া খেলা। এটি একটি নেশা। এটি কখনো দারিদ্র্য বা দেওলিয়াকে ডেকে আনে। ক্রমেই বিষণ্নতায় ভোগতে হয় এবং দিনাতিপাত করতে হয় বিষণ্নতার আগুনে। জুয়া মানুষকে উম্মাদ করে দেয়, নীতিনৈতিকতা কেড়ে নেয়। ইসলাম ধর্মে মদ,জুয়া দুটি-ই অবৈধ। ইরশাদ হয়েছে , তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এ দুটিতে রয়েছে মহাপাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ উপকারের চেয়ে অধিক। (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২১৯)
মিথ্যা কথা বলা। এটি বিশ্বস্ততা তুলে নেয়। বিভিন্ন গুনাহের রাস্তা খুলে দেয়। একটি গুনাহ অনেক গুনাহকে জন্ম দেয়। মিথ্যা সম্পর্কে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, آية المنافق ثَلاثٌ: إذا حَدَّثَ كَذَبَ، وإذا وعَدَ أخْلَفَ، وإذا اؤْتُمِنَ خانَ অর্থাৎ মুনাফিকের আলামত ৩ টি। ১. কথা বলার সময় মিথ্যা বলে ২.ওয়াদা ভঙ্গ করে ৩.আমাতের খেয়ানত করে। (বুখারি,হাদিস: ৬০৯৫; মুসলিম,হাদিস: ৫৯)
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এসকল নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।