ঈমান আনার পর প্রত্যেক বান্দার ওপর আবশ্যকীয় বিধান রয়েছে। প্রত্যেক বিধানই বান্দার মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির উপায়। বান্দাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আর তাঁর বিনিময়ে বান্দার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন আখেরাতের অফুরন্ত নিয়ামত। সে সমস্ত বিধান থেকে তৃতীয় যে বিধানটা রেখেছেন তা হলো, সাওম বা রোজা।
রাব্বে কারীম কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারা-১৮৩)
উক্ত আয়াতের দ্বারা বোঝা গেলো, বান্দার ওপর রোজা ফরজ। রোজা তার রাখতে হবে। কুরআনের আয়াত বা নস দ্বারা তার জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো সাওম বা রোজা। সঙ্গে সঙ্গে এ রোজা রাখার ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। বান্দা অনার্থক উপবাস থাকবে? নাকি এ উপবাসের পেছনে রয়েছে মহৎগুন? এ মহৎগুনটা কী? মাওলায়ে কারীম তো কোনো আদেশ করেন না, উদ্দেশ্যহীনভাবে। আমরা আয়াতের শেষাংশে দেখতে পাই রাব্বে কারীম বলেছেন,
যাতে করে তোমরা তাকওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো। আয়াতের শেষাংশ পড়ে বোঝতে পারি, তাকওয়া হাসিল বা অর্জন করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন।
তাকওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহর ভয়-ভীতি অর্জন করা। একটা মানুষ যখন আল্লাহর ভয় নিজের ভেতরে আনতে পারবে, তখনি সে মুত্তাকি হতে পারবে। আর হতে পারবে আল্লাহর নৈকট্যবান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহর ভয় যখন একজন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে, তখন তার দ্বারা কোনো পাপাচার হতে পারে না। তার দ্বারা হতে পারে না সমাজের কোনো অন্যায় কাজ।
সে অর্জন করতে পারে না অবৈধ সম্পদ। আজ পৃথিবীতে শান্তি শান্তি করে মানুষ ছোটাছুটি করছে। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না। সুষ্ঠ সমাজ বির্নিমানে মানুষ আজ পাগলপারা। কিন্তু সুষ্ঠ সমাজ নির্বিমানের উপকরণ তার জানা নেই। জানা নেই মানুষকে পরিশুদ্ধ করার পন্থা। এ দিশেহারা মানুষদের সঠিক পথ বাতলে দিতেই আসে রমজান। নিয়ে আসে সাওম বা রোজা। যা পালন করেই বান্দা অর্জন করতে পারে, তাকওয়া।
এই তাকওয়া কীভাবে অর্জিত হবে? কীভাবে ছোঁয়া পাওয়া যাবে এ মহা সোপানের? এ মহা সোপানের প্রধান উপায় হলো, আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি হলো, অন্তর সংশোধন, খাঁটি করা, পাপমুক্ত করা, কলুষমুক্ত করা। হৃদয় থেকে সমস্ত আবর্জনা সাফ করে একটি পরিশুদ্ধ অন্তর তৈরি করা। যে অন্তরে শুধুই আল্লাহর স্মরণ, আনুগত্য ও ইবাদত থাকবে। অন্য কোনো কিছুর জায়গা যেখানে থাকবে না। তার দ্বারা হবে না কোনো অন্যায়-অবিচার।
একজন মানুষ যখন পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে চাইবে, তখন সমস্ত গোনাহ ও অপরাধ থেকে অন্তর মুক্ত হতে হবে। মানুষের আত্মিক প্রশান্তি, উন্নতি ও বিকাশ সাধনের জন্যও আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন অপরিসীম। এ জন্য একজন মানুষ ঈমান আনার পর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো তাকওয়া বা খোদাভীরুতার। কেননা, এ খোদাভীরুতার কারণেই মানুষ অন্যায়, অবিচার থেকে দূরে থাকে। একজন মানুষের ভেতর যতো বেশি খোদা ভীরুতা থাকবে, তার দ্বারা তত বেশি ভালো কাজ হবে। তার দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ হতেই পারে না। কারো সম্পদ লুণ্ঠিত হতে পারে না। কারো মাল চুরি হতে পারে না।
পারে না কোনো মেয়ে লাঞ্ছিত, অপমানীত হতে। আজ আমাদের সমাজে আল্লাহর ভয় নেই। আমাকে মরতে হবে, দাঁড়াতে হবে মহান প্রভুর সম্মুখে, তার কাছে জবাব দিতে হবে, আমি যা করি প্রকাশ্যে ও গোপনে সব তিনি দেখেন, এটা যখন একজন বান্দার হৃদয়ে থাকবে। তখন কীভাবে তার কাছ থেকে অন্যায়-অবিচার হতে পারে? হতেই পারে না। অন্যায় করতে গিয়ে তার হৃদয়ে ভেসে উঠবে, আমার আল্লাহ আমাকে দেখছে। পৃথিবীর সমস্ত বিচারালয় থেকে মুক্তি পেতে পারি, কিন্তু মহান আল্লাহর বিচারালয় থেকে আমার তো মুক্তি নেই।
একজন মানুষ রোজা বা সাওম পালন করবে। আর সে সাওম বা রোজার উদ্দেশ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। ত্রিশটি রোজার সরমর্ম হলো, তাকওয়া অর্জন। অতএব আমাকে বোঝতে হবে, তাকওয়া বা খোদা ভীরুতা কোনো সাধারণ কথা নয়। হযরত উমর রাযি. উবাই ইবনে কাবকে প্রশ্ন করেন, তাকওয়া আসলে কী? উবাই পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কখনো কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গল অতিক্রম করেছেন?
উমর রাযি. বললেন, হ্যাঁ, উবাই। উবাই আবার প্রশ্ন করলেন, তখন আপনি কী করেন? উমর রাযি. বলেন, ‘আমি যথাসম্ভব আমার শরীর ও কাপড় বাঁচিয়ে চলি যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হই। উবাই বলেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া। মূলত এখানে পৃথিবীর মোহ ও লোভ-লালসা থেকে এভাবে বাঁচতে বোঝানো হয়েছে, যেমন করে কাঁটাময় প্রান্তরে নিজের জামাকে রক্ষা করে মানুষ চলাচল করে।
কুরআনে কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে (তদ্রুপ) ভয় করো যেরূপ তাঁকে ভয় করা উচিত এবং তোমরা এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, তোমরা মুসলমান। (সুরা ইমরান-১০২)
অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যপরায়ণদের সঙ্গে থাক। অর্থাৎ সত্যপরায়ণদের সাহচর্য অবলম্বন করো এবং তাদেরই মতো কাজ করো। (সুরা তাওবা-১১৯)
এখানে এক নম্বরে বলা হয়েছে, আল্লাহকে ভয় করার জন্য। দ্বিতীয় বলা হয়েছে, সত্যপরায়ণদের সঙ্গী হতে। তাদের মতো কাজ করতে। আমাদের দেশে একটি প্রবাদবাক্য আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। কঠিন একটা বাস্তব ও নিরেট কথা। জীবনকে বদলে ও সুন্দর জীবন পেতে সুন্দর মনের মানুষের সঙ্গলাভ করা আবশ্যক। হাদিসে আছে, যে যার সঙ্গে চলবে, কাল হাশরে সে তার সঙ্গে হাশরের মাঠে উঠবে।
নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর ভয় পরিপূর্ণ অন্তরে ঢোকাতে হলে ভালো মানুষের সংশ্রব আবশ্যক। আমরা চলতি পথে ভালো মানুষ খোঁজবো। ভালো মানুষের সঙ্গে জীবন-যাপন করবো। তবেই অনেক খারাপ কাজ থেকে বাঁচতে পারবো।
আত্মশুদ্ধির প্রধান উপায় হলো, খারাপ কাজ ত্যাগ করা। কুচিন্তা, কুঅভ্যাস বর্জন করা। সবসময় সৎচিন্তা ও সৎকর্ম, নৈতিক ও মানবিক আদর্শে স্বীয় চরিত্রকে গড়ে তোলা। আর এভাবেই আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জিনিস পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে, আর অন্তর পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো, জিকির (বায়হাকী)।
আমরা সর্বদায় আল্লাহর স্মরণ ও জিকিরে থাকবো। তবেই আমাদের অন্তর হবে পরিষ্কার, স্বচ্ছ। হৃদয়ে পাপের কারণে যে দাগ পড়ে গিয়েছে, তা দূর হবে। এ ছাড়াও যখনি সুযোগ হবে আমরা ইস্তিগফার, তাওয়াক্কুল, জুহদ, এখলাস, সবর, শোকর, কুরআন তেলাওয়াত, সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার চেষ্টা করবো।
আমাদের আত্ম যখন এ সমস্ত কুরীতি মুক্ত হবে, তখনি আমাদের তাকওয়া অর্জন হবে। আমাদের তাকওয়া অর্জন হলেই আমাদের এ রোজা রাখা ও রমজান স্বার্থক হবে। আমরা পুরোপুরি অর্জন করতে পারবো সিয়ামের কল্যাণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক:
আবদুল্লাহ আশরাফ
ছড়া ও গল্পকার, মাদরাসার শিক্ষক কিশোরগঞ্জ