পাপ এবং পূণ্য দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তা। একটি জান্নাতের অপরটি জাহান্নামের। একটি রবের নিকটবর্তী করে; অপরটি দূরত্ব বাড়ায়। একজন মানুষ তার ব্যক্তি জীবনে অসংখ্য পাপ কাজ করে থাকে। কিছু মানুষ পাপ কাজ করে যায় অনবরত।
পাপ কাজ করার পর তার বিবেক এতটুকু নাড়া দেয় না, সে যে কাজটা করছে সেটা পাপ বা গোনাহ। আবার কিছু মানুষ নফসের তাড়নায় শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়।যখন হুশ ফিরে, তখন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে এবং নিজের কৃত গোনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়।
ফিরে আসতে চায় সঠিক পথে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিরাশ করেননি,পথ দেখিয়ে দিয়েছেন পাপ মোচনের। আর, সেই পথ হলো ‘তাওবা’। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন —যারা নিজের উপর জুলুম করার পর তাওবা করবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মায়িদা: ৩৯)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন
হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো, বিশুদ্ধ তাওবাহ; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে,
হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। (সুরা আত তাহরিম-৮)
আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবে? এবং তারা যা করে ফেলে, জেনে-বুঝে তারা তা পুনরায় করতে থাকে না। [সূরা ইমরান-১৩৫]
অর্থাৎ, তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের নিকট (পাপের জন্য) ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁর কাছে তওবা (প্রত্যাবর্তন) কর। (সুরা হুদ ৩)
হাদিসে বর্ণিত তাওবার সুসংবাদ, আবু মুসা আশআরী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা নিজ হাত রাতে প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে। এবং দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবাহ করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে। (মুসলিম-৭১৬৫)
অন্য হাদিসে আল্লাহ রসুল (সা.) বলেন -হে মানব জাতি!তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, অর্থ্যাৎ আল্লাহর পথে ফিরে আস (মুসলিম-৭০৩৪)
উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে,
যদি কোনো বান্দা আপন কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হয় এবং সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাহলে আল্লাহ সেই সুযোগ বান্দাকে দান করেন।এক্ষেত্রে কতিপয় শর্ত প্রযোজ্য।
শর্তগুলো নিম্নরূপ, এক. পাপ কাজ পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে।দুই. নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং লজ্জিত হতে হবে ।তিনঃ সেই গোনাহ দ্বিতীয়বার না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।এই শর্ত গুলো ব্যতিত কখনোই মহান আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবুল করবেন না।
তাওবাহ করার পদ্ধতি
তাওবাহ করার কিছু উত্তম পদ্ধতি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন উম্মতকে। এক. তাওবার পূর্বে অযু করা। দুই.নফল নামাজ পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া। তিন. অতীতের পাপ মোচনের দোয়া করা। তবে, নফল নামাজ তাওবার জন্য জরুরি নয়।
তাওবা করার সময়সীমা-আমাদের অনেকের ধারনা মৃত্যুর নিদর্শন উপস্থিত হওয়ার পর তাওবা করতে হয়।কিন্তু, রাসূল(সা)বলেছেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ বান্দাহর তাওবাহ কবুল করেন মৃত্যুর যন্ত্রণা আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। (তিরমিজি: ৩৫৩৭)
একজন মুমিনের উচিত দিনে বহুবার তাওবা করা। আবূ হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর কসম! আমি প্রত্যহ ৭০ বারের অধিক আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করি। (বুখারি-৬৩০৭)
তাওবার ফলাফল-বিখ্যাত দার্শনিক ও গবেষক
ইমাম গাজ্জালী(রহ.) তার বিখ্যাত কিতাব মিনহাজুল আবেদীনে’ লিখেন
অতপর হে! ইবাদতকারী তোমার উপর কর্তব্য হল আল্লাহর নিকট তাওবা কর । আর তুমি তাওবা করবে দুইটি কারণে—এক.তাওবার কারণে আল্লাহ তোমাকে তার আনুগত্য করা সহজ করে দিবেন এবং তোমার নেক কাজ করার তাওফীক ও সৌভাগ্য লাভ হবে। গুনাহের পরিণতি হল, গুনাহ মানুষকে বঞ্চিত করার অভিভাবকত্ব করে এবং লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেয় এবং ধ্বংস করে দেয়। গুনাহতে আবদ্ধ লোককে আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলতে এবং আল্লাহর দীনের পথে অগ্রসর হতে গুনাহ বিরত রাখে।
গোনাহের ফলে ভালো কাজ ভালো লাগে না। যার ফলে ভালো কাজ করার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হয়। আর সবচেয়ে বিপদজনক কথা হল, যারা সবসময় গোনাহে লিপ্ত থাকে, তাদের অন্তর কালো হয়ে যায়, ফলে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
অন্তর ভাল মন্দের বিচার করতে অক্ষম হয়ে যায়। তাদের অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়। ফলে কোন ভাল কাজ তার অন্তর কবুল করে না।তখন একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া সে আর কোন মুক্তি বা নাজাতের পথ খুজে পায় না। কোন কিছুতেই তৃপ্তি অনুভব করে না। সে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে। নিজের জন্য কোথাও নিরাপদ স্থান খুঁজে পায় না এবং পায় না কোন আশ্রয় কেন্দ্র। পরিণতিতে গোনাহের ফলস্বরূপ সে ধাবিত হয় গভীর অন্ধকার ও ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে। গোনাহ তাকে ধীরে ধীরে শিরক ও কুফরের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
আরো আশ্চযের্র বিষয় হল, যে ব্যক্তি র্দুভাগা এবং যার অন্তর পাথরের চেয়েও বেশী কঠিন, তাকে কিভাবে আল্লাহর আনুগত্যের তাওফীক দেয়া হবে ? তাকে কিভাবে আহবান করা হবে কল্যাণের পথে ? অথচ সে গুনাহের কাজেই অবিচল, তার মধ্যে কোন অনুভূতি নাই। সে যে একজন অপরাধী ও অন্যায়কারী এ বিষয়ে তার মধ্যে কোন চেতনা জাগ্রত হয় না।
সুতরাং তাকে কিভাবে কাছে আনা হবে, যে নাপাকী ও র্দূগন্ধময় বস্তুর সাথে সর্বদা মাখামাখি করছে, গোনাহের কাজে লিপ্ত থাকে অহর্নিশি। এ ধরনের খুব কম লোকই আছে যারা পরর্বতীতে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসে এবং আল্লাহর ইবাদতে কোন স্বাদ আস্বাদন করে। যদি সে কোন দান-সদকা করে তা অনেক কষ্টে, এতে কোন স্বাদ উপভোগ করে না, আত্মার কোন তৃপ্তি হয় না এগুলো সবই হল গুনাহের পরিণতি এবং তাওবা না করার ফলাফল। জৈনক লোক সত্য কথাই বলছেন,
যদি তুমি দিনে রোজা এবং রাতে ইবাদত করতে না পার, তাহলে মনে রাখবে তুমি একজন হাতে পায়ে কড়া পরিহিত শিকলাবদ্ধ লোক। তোমার গুনাহই তোমাকে এ পরিণতিতে টেনে এনেছে।অতএব তুমি ধ্বংসের পথে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
মুমিন যখন কোন পাপ করে, তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর সে যদি তওবা করে, পাপ থেকে বিরত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে তার হৃদয় পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি আরো বেশি পাপ করে, তাহলে সেই দাগ তার হৃদয়কে গ্রাস করে নেয়। এই হল সেই জং, যার কথা আল্লাহ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন।(আহমাদ ৭৮৯২, তিরমিযী ৩৩৩৪, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩৪২২)
দুই: আর দ্বিতীয় বিষয় হল, তোমাকে যে কারণে আল্লাহর নিকট তাওবা করতে হবে তা হল, যাতে আল্লাহ তোমার ইবাদত গুলো কবুল করেন। কারণ, পাওনাদার সাধারণত উপঢৌকন গ্রহণ করে না। গোনাহ হতে বিরত থাকা, গুনাহ হতে তাওবা করা এবং প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করা হল ফরজ কাজ।
আর অন্যান্য সকল ইবাদত তা সবই নফল। সুতরাং, মূল পাওনা পরিশোধ ছাড়া আল্লাহ তায়াল্লা তোমার থেকে কিভাবে উপঢৌকন গ্রহণ করবেন? তুমি কীভাবে তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বৈধ ও মুবাহ কাজা গুলি ছেড়ে দিবে অথচ তুমি এখনো আল্লাহর নাফরমানী এবং নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত।
তুমি কিভাবে আল্লাহকে ডাকবে, তার সাথে মুনাজাত করবে এবং তার প্রশংসা করবে অথচ আল্লাহ তোমার উপর রাগান্বিত। মনে রাখতে হবে যারা আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত তাদের অবস্থা উল্লেখিত অবস্থার মোটেই ব্যতিক্রম নয়, তারা আল্লাহর অবাদ্ধতায় লিপ্ত অথচ তারা আল্লাহর নিকট দোয়া করে, আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।