জীবনমুখী ছড়ায় ভরপুর “জীবন-ছড়া”
জহুর মুনিম
জীবন-ছড়া—এসেছে জীবনের ছড়া থেকে। এ জীবন কোন জীবন? প্রাণীর জীবন? লেখক নিজে? না কি দুটোই? হয়তো তাই। বইয়ের নাম রহস্যময়। রহস্যে রস আছে, আছে সৌন্দর্য; যেমন সৌন্দর্য আছে বইটির প্রচ্ছদে।
জীবন-ছড়ায় আছে ছত্রিশটি ছড়া। ছড়াগুলোর শরীর ও আবেদনে আছে ভিন্নতা। বই খুললেই দেখব প্রভু শিরোনামের ছড়া। প্রথম ছড়ার প্রথম স্তবকেই ছড়াকার আবদুল কাদির জীবন জীবন-ছড়া গ্রন্থের সার্থকতা দেখিয়েছেন। বলছেন—
যত আছে মনের কথা
প্রভুর কাছে বলি
বিপদ-আপদ যা আছে তা
সবই যাবে চলি।
সার্থকতা কোথায়? আসুন দেখি—জীবন-ছড়া মানে জীবনের ছড়া। জীবন মানেই যন্ত্রণা। যে যন্ত্রনার উত্তরণ পেতে আমরা রোজ রবের কাছে হাত তুলি। চলে যায় আমাদের বিপদ-আপদ, আমরা পাই শান্তির জীবন।
এরপরই আছে নবীর শানে ছড়া। এই ছড়া কেন প্রভু শিরোনামের ছড়ার পর আনতে হলো? লেখক বলছে—
মোহাম্মদের নাম মোবারক
রবের পাশে রয়
নবীর শানে আরশ এবং
জগৎ আলোকময়।
কেন মোহাম্মদের নাম রবের পাশে রয়? এর জবাবে বলছেন—
ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ নবী
বন্ধু মহান রবের
শেষ বিচারে যামিন হবেন
উম্মতি যে সবের।
ধর্ম-বিষয়ক আরও দুটো ছড়ার পরে আছে গাঁয়ের ছবি শিরোনামের ছড়া। ছড়াকার বর্ণনা করেছেন গাঁয়ের সৌন্দর্য। লেখকরা গাঁয়ে যে পরিমাণ লেখার উপকরণ পান, শহরে তা পান না। তাই তো শেষে এসে বলছেন—
এমনি কতক চিত্রশালা
ভেসে উঠে চোখে
ইট পাথুরে শহর-জীবন
কষ্ট বাড়ায় বুকে।
ছোট্ট জীবনের এই যে এত এত যন্ত্রণা, এর কারণ কী? অনেকেই মনে করে অর্থাভাব। সত্যিই কি তাই? ছড়াকার কিন্তু তা মানতে নারাজ। কেন নারাজ—তার পেছনে দাঁড় করিয়েছেন যুক্তি। শান্তি শিরোনামের ছড়ায় বলছেন—
কোটি টাকার মালিক হয়েও
অশান্তিতে পোড়ে
দিন-মজুরের ঘরেও কিন্তু
শান্তি মিলে খোঁড়ে।
প্রেম মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবন তাঁর জীবন-ছড়া থেকে এই অবিচ্ছেদ্য অংশকে বিচ্ছেদ করেননি। ময়না পাখি ছড়াটি প্রেমরসে ভরপুর। তবে এ প্রেম নড়বড়ে প্রেম নয়, খাঁটি প্রেম। প্রশ্ন করবেন—কীভাবে বুঝলাম! ছড়াকার বুঝিয়েছেন। তিনি যে বললেন—
রাগ হলো তার নিত্যসাথি
অল্প কিছু হলে
চলে যাবে রাগ করে সে
আমায় তখন বলে।
রাগ তো সেই করে; ভালোবাসে যে। আর রাগ কিন্তু প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। খাঁটি প্রেমের রাগ হয় সাময়িক, পরের স্তবকেই তা প্রমাণ হয়—
যখন আমি হাত দুটি তার
বুকের উপর রাখি
সব অভিমান ভুলে ময়না
ভেজায় জলে আঁখি।
বাবা নিয়ে লেখা হয় তুলনামূলক কম। আবদুল কাদির জীবন তাঁর ছড়াগ্রন্থে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন। বাবা এমন এক মানুষ, যাঁকে আমরা ভালোবাসি এবং একই সাথে ভয় করি। বাবা আমাদের মাথার উপর ছায়ার মতো। ছড়াকার এই দৃষ্টিকোণ মাথায় রেখে ছড়ার শিরোনাম দিয়েছেন বটবৃক্ষ পিতা। শুরুতে বলছেন—
পৃথিবীতে যত মায়া
বাবার কাছে পাই
বিপদ-আপদ এলেই তো পাই
পিতার কাছে ঠাঁই।
ছড়াটির শেষাংশের সাথে আমি; আমরাও প্রার্থনা কর—
বাবার হায়াত দাও বাড়িয়ে
প্রভুর কাছে চাই
বাবার মতো এত আপন
পৃথিবীতে নাই।
আবদুল কাদির জীবন একজন ছড়াকার। তিনি জানেন ছড়ার শক্তি। ছড়া শিরোনামের ছড়ার শুরুতে তাই বলছেন—
দেশ-সমাজের চিত্রটা আজ
ফুটে উঠে ছড়ায়
ছড়া এখন রাজার মতো
বেড়াচ্ছে এই ধরায়।
একজন ছড়াকার যখন দুঃখে থাকেন, একা থাকেন; তখন তার একমাত্র সঙ্গী হয় ছড়া। ছড়া কাজ করে মায়ের মতো, ছড়ায় দুঃখগুলো বলার পর দুঃখ সেভাবে চলে যায়, যেভাবে মায়ের স্পর্শে চলে যায় আমাদের ব্যথা।
একজন লেখক তার লেখায় সময়কে ধারণ করেন। আবদুল কাদির জীবনও ব্যতিক্রম নয়। জীবন-ছড়ায় করোনা নিয়ে তাই ছড়া লিখেছেন। বইটির শেষ ছড়া বন্যা দেখলে মনে পড়ে সিলেটের ভয়াবহ বন্যার কথা। তখনকার ভয়ানক চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে—
ডানে পানি, বামে পানি
পানি চতুর্দিকে
গরিব-দুখীর মুখের হাসি
তাই হলো আজ ফিকে।
বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন দেশবিখ্যাত ছড়াকার জুলফিকার শাহাদাৎ। তিনি বলেছেন—জীবন বিশ্বাসী মানুষ। আমরাও তা বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি—তাঁর দৃষ্টি দূরে। তিনি ছাড়িয়ে যেতে চান সবাইকে। ছড়িয়ে যেতে চান সারা দেশে!
বই ও বইর জনককে নিয়ে দারুণ মন্তব্য করেছেন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক। বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর দুজন প্রিয় লেখক ঔপন্যাসিক আলেয়া রহমান ও কবি আজমল আহমদ-কে।
নান্দনিক এই ছড়াগ্রন্থ বেরিয়েছে পাপড়ি থেকে। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ-এর অষ্টাদশ কেমুসাস বইমেলা-২০২৪ ও অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ উপলক্ষে। পরিবেশক রকমারি ডটকম, পাপড়ি ডটকম ও অটোগ্রাফ পাবলিকেশন। মূল্য ধরা হয়েছে দুশো টাকা।
জীবনমুখী ছড়ায়, নাঈমুল ইসলাম গুলজার-এর নান্দনিক প্রচ্ছদে, অন্য আট-দশটি বইয়ের চেয়ে ভিন্ন সাইজে জীবন-ছড়া হয়েছে মনকাড়া। লেখক ও তাঁর বইটির জন্য যাবতীয় শুভকামনা।