বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ২০২৪ এক অনন্য বছর। মাঠ এবং মাঠের বাইরের নানা কারণে দীর্ঘদিন ক্রীড়া অনুরাগীদের মনে থেকে যাবে এর স্মৃতিগুলো। এ বছরই মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় আলোচিত ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যেখানে এসেছেন নতুন একজন সভাপতি। সাকিব আল হাসানের অবসর এবং দেশে ফেরা নিয়েও জলঘোলা হয়েছে অনেক। এ বছরই পাকিস্তানকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করেছে টাইগাররা। ভারতে না পারলেও, উইন্ডিজ চমক দিয়ে বছর শেষ করেছেন ক্রিকেটাররা। এর আগে, একজন ক্রিকেটারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে চাকরি হারান চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। ঘটনাবহুল এ বছরের আদ্যোপান্ত থাকছে এ প্রতিবেদনে।
২০২৪, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ঐতিহাসিক এক বছর। পুরো দেশ যেখানে বদলে গেছে আমূলে, সেখানে ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব পড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। তবে, অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভুগেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। পরিস্কার করে বললে, দেশের ক্রিকেট বোর্ড। তবে, এ সব কিছুই বছরের শেষ দিককার কথা, চলুন শুরুটা একেবারে শুরু থেকে শুরু করি।
২০২৪ বিপিএলে আলোচনায় সাকিব আল হাসান। সেটাও মাঠের ক্রিকেটে নয়। চোখের সমস্যা ধরা পড়ে অলরাউন্ডারের। ইংল্যান্ড-ভারতে চিকিৎসা করেও সমাধান পাননি। ব্যাটিংয়ে সমস্যা হওয়ায় প্রথমবারের মতো বোলার হিসেবে ম্যাচ খেলেন তিনি। যদিও, সে বিপিএলে শেষ পর্যন্ত মূল আলোচনায় ছিলেন তামিম ইকবাল। তার নেতৃত্বেই যে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে ফরচুন বরিশাল। ৪৯২ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা হন তামিম।
এ বছর ক্রিকেটে আরও একটি ঘটনা ছিল আলোচনার শীর্ষে। ২০২৩ বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের তদন্ত রিপোর্ট। যেখানে আলাদা করে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলা হয় নাসুমের চড় কাণ্ড ও তামিমের বাদ পড়া নিয়ে। যদিও, সে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি আজও। তবে, গণমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন আলোচনা থেকে জানা যায়, সব কিছুর মূলে ছিলেন চান্ডিকা হাথুরুসিংহে।
এসব আলোচনার মধ্যেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্র যায় বাংলাদেশ দল। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে যেয়ে উলটো স্বাগতিকদের বিপক্ষে সিরিজ হেরে বিপাকে পরে শান্ত বাহিনী। পরে বিশ্বকাপে সেরা আটে উঠলেও সেমির টিকিট না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা।
এরপরই আসে সে ক্ষণ। যখন বদলে যায় বাংলাদেশ। জুলাই থেকে আগস্ট কোটা আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্রজনতার গণ আন্দোলনে। যেখানে জনতার বিক্ষোভের মুখে ভূপাতিত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এই পুরো আন্দোলন চলাকালে সাকিব-মাশরাফীর নিরবতা ক্ষুব্ধ করে দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের। ৫ আগস্টের পর তারা ব্রাত্য হয়ে পড়েন দেশের ক্রিকেটে। বদলে যায় ক্রিকেট বোর্ডও। পতিত সরকারের সঙ্গে পালিয়ে যান বিসিবির প্রেসিডেন্টসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচালক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সে জায়গায় আসে নতুন মুখ। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার পরামর্শে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে নেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। পরিচালক হন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বাদ পড়েন জালাল ইউনুস, সাজ্জাদুল আলম ববি। পদত্যাগ করেন খালেদ মাহমুদ সুজন ও নাঈমুর রহমান দুর্জয়রা।
কিন্তু এ টানাপোড়েনে বাংলাদেশ হারায় নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার সুযোগ। নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী দেশ। পরে, বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়া হয় আরব আমিরাতে। যদিও, হোস্ট রাইট রাখা হয় বাংলাদেশের কাছেই।
এর মাঝেই বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটাররা ঘটায় এক অসম্ভব ঘটনা। পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে সাদা পোশাকে হোয়াইটওয়াশ করেন শান্ত-মিরাজরা। যার জন্য বিসিবির পাশাপাশি দলকে সংবর্ধনা দেন প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর ভারত সিরিজে গিয়ে অবশ্য সে ফর্মের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি টাইগাররা। সব ফরম্যাটে হেরে ধবলধোলাই হন তারা। ভারত সফরে টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। জানান সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলে অবসর নিতে চান তিনি। টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ।
তবে, সাউথ আফ্রিকা সিরিজ শুরুর আগেই বড় এক ধাক্কা খায় টাইগার ক্রিকেট। চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেয় বিসিবি। নাসুমের চড় কাণ্ডে তাকে শোকজও করে তারা। নতুন কোচ হিসেবে সাবেক উইন্ডিজ ক্রিকেটার ফিল সিমন্সের হাতে তুলে দেয়া হয় শান্তদের দায়িত্ব।
কোচ বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি টাইগারদের। সাউথ আফ্রিকা সিরিজেও ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের। কিন্তু সে সিরিজ মানুষ মনে রাখবে সাকিব আল হাসানের জন্য। কারণ, তিনি দেশে আসবেন কি আসবেন না, তা নিয়ে পুরো দুই দিন চলে মেগা সিরিয়াল। শেষ পর্যন্ত দেশে আসা হয়নি তার।
শারজায় আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যায় বাংলাদেশ। সেখানে টেস্ট সিরিজ ড্র করে তাক লাগিয়ে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। বাংলাদেশের পেস বোলারদের প্রশংসা ঝরে কিংবদন্তিদের মুখে। এরপর ওয়ানডে সিরিজ হারলেও, টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিবিয়ানদের হোয়াইটওয়াশ করে বছরটা দারুণভাবে শেষ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এর মাঝে বিসিবিতেও চলে কর্মযজ্ঞ। বিপিএলের আগে এনসিএল টি-টোয়েন্টি আয়োজন করে স্থানীয় ক্রিকেটারদের প্রশংসা কুড়ায় ফারুক আহমেদ বাহিনী। একইসঙ্গে বিপিএলের মাসকট, থিম সং প্রকাশ এবং ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে কনসার্টে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শহীদদের জন্য বিশেষ সম্মাননার ব্যবস্থা করেও প্রশংসিত হয় ক্রিকেট বোর্ড।